Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৬ বৃহস্পতিবার, মে ২০২৪ | ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

যে কারণে বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা  

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:২৯ PM
আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:২৯ PM

bdmorning Image Preview


দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত। এমন একজন বেকার মোস্তফা ওয়াসিফ মিঠু। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি। এ পর্যন্ত ১০-১২টি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিলেও চাকরি হয়নি মিঠুনের। ঠিক একই অবস্থা ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র আশরাফুল ইসলাম  তপুর।

মিঠু জানান, তার ডিপার্টমেন্ট থেকে ৬৬ জন পাস করেছেন দুই বছর আগে। এর মধ্যে মাত্র দশজনের চাকরি হয়েছে। বাকিরা এখনো বেকার।

এদিকে তপুও জানান, তাদের ব্যাচের ২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে চাকরি পেয়েছেন ৫-৭ জন। কারো কারো চাকরি আবার খণ্ডকালীন। বাকিদের চাকরি কবে হবে, আদৌ হবে কি-না, তা বলা মুশকিল।

মিঠু-তপুর মতো এরকম লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর কাছে চাকরি হয়ে উঠেছে 'সোনার হরিণ'।

শিক্ষার হার বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকার, যা উদ্বেগের বিষয়। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার প্রায় ৩৭ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ৩৪ শতাংশ।

এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা তরুণ-তরুণীর মধ্যে বেকারের হার যথাক্রমে ২৭ ও ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশে কারো শিক্ষার ডিগ্রি যত বড়, তার বেকার হওয়ার বা থাকার আশঙ্কাও তত বেশি।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। এসএসসি, এইচএসসি, বিএ এবং এমএ পাস ৬ লাখের বেশি তরুণ-তরুণীর ওপর জরিপ করে এসব উপাত্ত পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

মূল কারণ শিক্ষার নিম্নমান :

এজন্য শিক্ষার নিম্নমানকেই দায়ী করে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা জানান, উচ্চশিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছেছে। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদি এর কারণ।

অর্থনীতিবিদরা জানান, বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। শ্রমবাজারের তুলনায় চাকরির বাজার ছোট হওয়ায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও চাকরি পাচ্ছেন না। 'বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের চিত্র অনেকটাই বিপরীত। এ দেশে শিক্ষিতের বেকার হওয়ার আশঙ্কা অশিক্ষিতদের তুলনায় বেশি।

কর্মসংস্থানের বড় উৎস অনানুষ্ঠানিক খাত :

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ২৬ লাখ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী কর্মরত মোট জনগোষ্ঠী (শ্রমশক্তি) ৫ কোটি ৮০ লাখ। এর বড় অংশ প্রায় ৫ কোটিই হকার, ফেরিওয়ালা, গৃহকর্মী, গাড়িচালকসহ বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক খাতের।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, যারা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ পান না, তাদের বেকার ধরা হয়। আইএলও প্রকাশিত 'ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকার ছিল বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ সালে। তখন বেকার ছিলেন ২০ লাখ।

২০১২ ও ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৪ লাখ ও ২৮ লাখ। দেশে যে হারে বেকার বাড়ছে, তাতে চলতি বছরের শেষে এ সংখ্যা ৩০ লাখে গিয়ে ঠেকবে বলে আইএলও’র পূর্বাভাসে বলা হয়। তবে বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।

প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কমছে কর্মসংস্থান! :

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার যে হারে বাড়ছে, তাকে অনেকেই 'বিস্ময়কর সাফল্য' হিসেবে অভিহিত করেছেন। কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও উচ্চ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। সরকার আশা করছে, নানা প্রতিকূলতার পরও চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

স্বাভাবিক নিয়মে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ে। বাংলাদেশে এর উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে সে অনুযায়ী বাড়ছে না কর্মসংস্থান।

পরিসংখ্যান মতে, ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৩ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। ওই সময়ে প্রতিবছর গড়ে কর্মসংস্থান হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ। অন্যদিকে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাত্র ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

অর্থাৎ ২০১৩-১৫ সালে প্রতিবছর গড়ে তিন লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে, যা আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা জানান, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেই :

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন একটা নেই। চলতি অর্থবছরের বাজেটে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ঘোষণা দেয়া হয়। যদিও কোন খাতে কতটি হবে, কীভাবে হবে সে বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় কোনো কিছুই বলা হয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, সরকারি খাতে প্রতিবছর মাত্র ৫ শতাংশ লোক চাকরি পান। বাকি ৯৫ শতাংশ চাকরির উৎস বেসরকারি খাত। এদিকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে ২৩ শতাংশে এসে স্থবির হয়ে আছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা জানান, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য, নানা প্রণোদনা দেয়ার পরও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না।

ঝোঁক বেশি সরকারি চাকরির দিকে :

বর্তমান সময়ে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বিশেষায়িত ও কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিতের সরকারি চাকরি বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারের প্রতি ঝোঁক বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষার্থীরা জানান, বিসিএস ক্যাডারে চাকরি পেলে কম সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া যায়। ক্ষমতাও প্রয়োগ করা যায় নানাভাবে। সরকারি চাকরিতে বর্তমানে বেতনসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও বেশি। সে জন্য তারা সরকারি চাকরির প্রতি উৎসাহী।

Bootstrap Image Preview