আওয়ামী লীগের ৮১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির ৪২ পদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি রয়েছে ৩৯টি পদ। এর মধ্যে সম্পাদকমণ্ডলীতে ১০টি, কোষাধ্যক্ষ ও নির্বাহী কমিটির ২৮টি পদ শূন্য আছে। এর বাইরে উপদেষ্টামণ্ডলীতে ফাঁকা আছে ১০ টি পদ। এই পদগুলোতে স্থান পাওয়ার আশায় বাদ পড়া নেতারা।
আজ নতুন কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর প্রথম সভা। এই সভা শেষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের পুনর্নিবাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের ৫১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের ৪০ পদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে; বাকি রয়েছে ১১টি পদ।উপদেষ্টামন্ডলীতে স্থান পেতে বাদ পড়া জ্যেষ্ঠ নেতারা নানাভাবে দেনদরবার করছেন। অনেকে এটিকে প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নিয়েছেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী, চার প্রতিমন্ত্রী, দুই উপমন্ত্রীসহ আগের কমিটির ১০ প্রভাবশালী নেতার নাম নেই ঘোষিত আংশিক কমিটিতে। এটি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকার ও দল আলাদা করার অংশ হিসেবে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে কমিটি থেকে। তাদের সরকারে মনোযোগী হওয়ার বার্তা দেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনও ঘোষণা করা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাদের রাখা হতে পারে। সে কারণে তারাও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাদের নাম দেখার অপেক্ষায়।
এদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রীকে রাখা হবে না। কারণ সাংগঠনিক পদে যারা দায়িত্ব পান তাদের সারাদেশ চষে বেড়াতে হয়। মন্ত্রিত্বের গুরু দায়িত্ব পালনের পর এই পদে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে আলোচনা থাকলেও এবারও শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসছেন না বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য কোনো সদস্য। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রোববার দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শেখ রেহানা, রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সজীব ওয়াজেদ জয়- কেউই এখনই রাজনীতিতে আসতে আগ্রহী নন। শেখ পরিবারের অন্য কেউ রাজনীতিতে আসবে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের আংশিক কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই কমিটিতে। নেই কোনো চমকও। পুরনো নেতায় নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিদায়ী কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সবাই নতুন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। তবে আগের কমিটির শূন্য তিন পদে নতুন করে তিনজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন– আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী কমিটির দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান এবং সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খান।
এ ছাড়া আগের কমিটি থেকে পদোন্নতি পেয়েছেন আটজন। আর একেবারেই নতুন মুখ এসেছেন মাত্র দুজন। তারা হলেন- প্রেসিডিয়াম পদে শাজাহান খান ও মহিলাবিষয়ক সম্পাদক পদে সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।
প্রেসিডিয়ামে কোনো পরিবর্তন না এলেও গতকাল পর্যন্ত যাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে নেই আগের কার্যনির্বাহী সংসদের ১০ প্রভাবশালী নেতার নাম। তাদের মধ্যে সাতজনই মন্ত্রিসভার সদস্য। তারা হলেন- বিদায়ী কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, আইনবিষয়ক সম্পাদক ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, বিদায়ী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা এবং ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
এ ছাড়া বিদায়ী উপদেষ্টা পরিষদের দুজনের নাম ঘোষণায় আসেনি। তারা হলেন- মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। যদিও উপদেষ্টা পরিষদের ১১টি পদ এখনও খালি আছে।
আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির এখন পর্যন্ত ঘোষিত তালিকায় তরুণদের জায়গা হয়নি। শূন্য পদগুলোতে তরুণ নেতাদের কতজন স্থান পান, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা ইতিমধ্যেই পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এ ছাড়া সম্পাদকমণ্ডলী থেকে বাদ পড়া নেতাদের কেউ কেউ শূন্য পদে ফিরে আসছেন কি না, সেটাও আলোচনায় আছে।
২০১৬ সালের কমিটিতে বেশ কিছু তরুণ নেতা সম্পাদকমণ্ডলীতে স্থান পেয়েছিলেন। এর মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী বাদ পড়েছেন। শুধু বিপ্লব বড়ুয়া পদোন্নতি পেয়ে উপদপ্তর থেকে দপ্তর সম্পাদক হয়েছেন। বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন স্বপদেই আছেন। সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী মারুফা আক্তার নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এবারও সদস্য হিসেবেই থাকবেন বলে নেতারা মনে করছেন।
কাউন্সিলে অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য, শ্রম, ধর্ম এবং তথ্য ও গবেষণা—এই পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকের পদ ঘোষণা করা হয়নি। এসব পদে নতুন মুখ আসার কথা শোনা যাচ্ছে।
অর্থ সম্পাদকের পদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও ধর্মবিষয়ক সম্পাদক পদে ধর্মমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে কোনো মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীর স্থান হয়নি। ফলে এ দুটি সম্পাদকের পদেও কোনো মন্ত্রী স্থান পাবেন না বলে দলীয় নেতারা মনে করছেন।
আগের কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ সংসদ সদস্য নন। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়ার পর তাদের আর কোনো সাংগঠনিক বা সরকারি দায়িত্ব থাকছে না। ফলে তাদেরকে সম্পাদকীয় কিংবা কার্যনির্বাহী সদস্য পদে রেখে দেয়া হতে পারে।
সম্মেলনের আগে বারবার বলা হয়েছে, এবারের কমিটিতে তরুণ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের স্থান দেয়া হবে। কিন্তু আংশিক কমিটিতে সে কথার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক, তিনটি সাংগঠনিক সম্পাদক এবং উপদপ্তর ও উপপ্রচার সম্পাদকের পদ পেতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা আশায় আছেন। তারা রীতিমতো দৌড়ঝাঁপও করছেন।
এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাবেক নেতারা নিজেদের ‘অবদানের’ কথা প্রচার শুরু করেছেন। বিশেষ করে এক–এগারোর সময় কার কী ভূমিকা ছিল, সেসব ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্যদের ২৮টি পদের মধ্যে আগের কমিটিতেই দুটি পদ শূন্য ছিল। এবার সেই কমিটি থেকে তিন নেতার পদোন্নতি হয়েছে। ফলে পাঁচজন নতুনকে নেয়ার সুযোগ আছে। ২০১৬ সালে ১২ জন নির্বাহী সদস্য প্রথমবার গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান। বাকিদের একটা বড় অংশই গুরুত্বপূর্ণ সংসদ সদস্য।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা পর্যায়ের কিছু ত্যাগী ও প্রবীণ নেতাকে সব সময়ই কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। বিশেষ করে যেসব জেলা নেতার দলে ভূমিকা আছে, কিন্তু মন্ত্রী–এমপি করা সম্ভব হয়নি। এবারও তাদের মূল্যায়ন করা হতে পারে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, নবীন–প্রবীণের সমন্বয়েই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণ করা হবে। ৩৯টি পদ শূন্য আছে, সেগুলোতে তরুণ মুখ থাকবে। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে কোনো মন্ত্রী থাকবেন না বলে জানান তিনি।
আজ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভার পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। গঠনতন্ত্র অনুসারে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্যের পদগুলো সভাপতিমণ্ডলীর পরামর্শে সভাপতি পূরণ করবেন।
রেওয়াজ ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলের পর প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যপদে নেতা মনোনীত করার বিধান আছে। গঠনতন্ত্রের ১৯ ধারায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি গঠনতন্ত্রের ১৮ ধারায় বর্ণিত কার্যনির্বাহী সংসদের ২৮ জন সদস্য সভাপতিমণ্ডলীর সহিত আলোচনাক্রমে মনোনয়ন দান করিবেন এবং উক্ত মনোনয়ন কাউন্সিল অধিবেশন সম্পন্ন হওয়ার ২১ দিনের মধ্যে ঘোষিত হইবে।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় কমিটির ফাঁকা রাখা অন্যান্য পদে মনোনয়ন দিতেই আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের নতুন সদস্য আবদুর রহমান রোববার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, প্রেসিডিয়ামের প্রথম বৈঠকে মূলত কমিটি সংক্রান্ত ব্যাপারেই আলোচনা হবে। এ ছাড়া দায়িত্ব বণ্টন এবং কীভাবে টিমওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। সংগঠনকে কীভাবে তৃণমূল থেকে নতুন উদ্যমে সাজিয়ে-গুছিয়ে আনা যায় সে আলোচনা হবে।