Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৯ বৃহস্পতিবার, মে ২০২৪ | ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

হাজারো মানুষের ভালবাসায় চিরনিদ্রায় সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া, অঝোরে কাঁদছেন স্ত্রী

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ জুলাই ২০১৯, ০৭:০৯ PM
আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৯, ০৭:০৯ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


দায়িত্ব পালনকালে কাভার্ডভ্যানের চাপায় নিহত ট্রাফিক সার্জেন্ট মোঃ গোলাম কিবরিয়া মিকেলের তৃতীয় জানাযা নামাজ শেষে তার গ্রামের বাড়ি মির্জাগঞ্জের পশ্চিম সুবিদখালী সরদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাদা দাদীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের কর্নকাঠী এলাকায় কর্মরত অবস্থায় এ ঘটনা ঘটে।

বেলা ১০টা ১৭ মিনিটে নিহত সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া মিকেলের লাশ বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স উপজেলার সুবিদখালীতে পৌঁছলে তার সহপাঠী,আত্মীয় স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার শোকার্ত মানুষের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া মিকেলকে শেষ বারের মতো এক নজর দেখতে আসা সহপাঠী,আত্মীয় স্বজন ও বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের ঢল নামে।

বুধবার বেলা ১১টায় সুবিদখালী সরকারী রহমান ইসহাক পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে পটুয়াখালী পুলিশ সুপার মোঃ মাঈনুল হাসান পিপিএম এর নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান শেষে তার জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে গতমঙ্গলবার বিকেল ৫টায় ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে তার প্রথম জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনে জানাযার নামাজ শেষে ঐদিন বিকেলেই পুলিশের লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ীতে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় শেষ কর্মস্থল বরিশালে। সকাল ৮টায় বরিশাল পুলিশ লাইনে তার দ্বিতীয় জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বরিশালে জানাযার নামাজ শেষে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ীতে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার জন্মস্থান মির্জাগঞ্জের সুবিদখালীতে।

তার লাশ গ্রহন করতে ও রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে পটুয়াখালী-১ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোঃ শাহজাহান মিয়া,পটুয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মাঈনুল হাসান পিপিএম,পটুয়াখালী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোঃ খলিলুর রহমান মোহন মিয়া, পটুয়াখালী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট গোলাম সরোয়ার,উপজেলা আওয়ামীলীগের আহবায়ক মোঃ গাজী আতাহার উদ্দীন, মির্জাগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খাঁন মোঃ আবু বকর সিদ্দিকী, মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সরোয়ার হোসেন ও মির্জাগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মাছুমুর রহমান বিশ্বাস সহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা,স্থানীয় আওয়ামীলীগ,যুবলীগ,ছাত্রলীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী উপস্থিত ছিলেন।

জানাজা শেষে দুপুর পৌনে বারোটার সময়ে উপজেলার পশ্চিম সুবিদখালীর গ্রামের নিজ বাড়িতে তাঁর লাশ পৌছলে স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদরক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাঁর দাদা-দাদীর কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।

মিকেলের লাশ তাঁর এক সহকর্মী সার্জেন্ট মোঃ নিজাম কবরে সমাহিত করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। মিকেলের অন্য সহকর্মী সার্জেন্ট মোঃ শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে পুলিশে যোগদানের পরে সততার সাথে কাজ করেছেন মিকেল। আমরা সহকর্মী হিসেবে তাঁর এই অস্বাভবিক মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তাঁর মতো মেধাদৃপ্ত চৌকস পুলিশ সার্জেন্টের অকাল প্রয়ান কোন ভাবেপূরন হবার নয়।

আমারা দেশের প্রচলিত আইনে ঘাতক ট্রাক চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। মির্জাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম আহবায়ক প্রফেসর মোঃ ইউনুস আলী সরদার ও মাতা মোসাম্মৎ শাহিদা বেগমের ১ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে নিহত সার্জেন্ট মিকেল একমাত্র বড় ছেলে ছিলেন। তিন বছর আগে বিয়ে করেন কিবরিয়া।

এদিকে সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া মিকেলের মৃত্যুতে নিজ বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। অঝোরে কাঁদছিলেন স্ত্রী মৌসুমি আক্তার মৌ। তার চোখের পানি অনবরত ঝরছিল। কান্না করতে করতে মৌসুমি বলেন, ‘আমি কিছুই চাই না। আমি আমার স্বামীকে চাই। আমি আমার সুখের সংসার চাই। কি হবে আমার আর আমার শিশুসন্তানের।’

এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শোকবার্তা দিয়ে আহাজারি করছেন তার বন্ধু ও সহকর্মীরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গোলাম কিবরিয়া নামে পুলিশ মহলে পরিচিত থাকলেও মূলত বন্ধু-বান্ধবের কাছে মিকেল হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে বাড়ি হলেও শহরে থাকতেন সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া। পুলিশের দায়িত্ব পালন শেষে বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতেন। সবসময় শান্ত ও হাসিখুশি ছিলেন কিবরিয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ২০১৫ সালে পুলিশে যোগ দেন। পুলিশে যোগ দেয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বরিশালে কোনো বন্ধু-বান্ধব গেলে আপ্যায়ন না করে ছাড়তেন না কিবরিয়া। এসব কারণে বন্ধু ও শিক্ষক মহলে জনপ্রিয় ছিলেন সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া।

জানা যায়, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী বন্দরের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলী সরদারের বড় ছেলে গোলাম কিবরিয়া মিকেল। তার ছোট এক বোন রয়েছে। তিন বছর আগে বিয়ে করেন কিবরিয়া। মিকেলের স্ত্রী পুলিশের সার্জেন্ট মৌসুমি আক্তার মৌ বরিশালে কর্মরত। তাদের দুই বছরের এক ছেলেসন্তান রয়েছে। পটুয়াখালী সরকারি কলেজে পড়ালেখা করেছেন কিবরিয়া।

গতকাল সোমবার সকাল থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের কর্নকাঠি জিরো পয়েন্ট এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে পটুয়াখালীগামী যমুনা গ্রুপের বেপরোয়া গতির একটি কাভার্ডভ্যানকে (ঢাকা-মেট্রো-উ-১২-২০৫৪) থামার সংকেত দেন সার্জেন্ট কিবরিয়া।

সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়ার অকাল মৃত্যুতে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারুক হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার স্নেহের ছাত্র মিকেল পুলিশ সার্জেন্ট বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কর্মরত অবস্থায় কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মঙ্গলবার সকালে মারা গেছেন। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।’

মিকেলের বন্ধু বাপ্পী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বন্ধু, তোমার অকালে চলে যাওয়া আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আল্লাহ তোমাকে জান্নাত দান করুক।’

মিকেলের বন্ধু এসডি সুমন লিখেছেন, ‘প্রিয় সতীর্থ পুলিশ সার্জেন্ট মিকেল সোমবার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দায়িত্বরত অবস্থায় কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তোর চলে যাওয়া মানতে পারছি না বন্ধু। ভালো থাকিস পরপারে, তোর জন্য দোয়া রইলো।’

সাখাওয়াত সোহেল নামে আরেক বন্ধু লিখেছেন, ‘কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোক জানাচ্ছি আমরা। মহান আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসিব করেন।’

কাভার্ডভ্যানটি ট্রাফিকের সংকেত অমান্য করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় সার্জেন্ট কিবরিয়া একটি মোটরসাইকেলে ধাওয়া করে কাভার্ডভ্যানটির সামনে গিয়ে ফের তাকে থামার সংকেত দেন। কাভার্ডভ্যানচালক জলিল মিয়া এ সময় মোটরসাইকেল আরোহী সার্জেন্ট কিবরিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে তার দুই পায়ের চারটি স্থান ভেঙে যায় এবং মূত্রথলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী ঝালকাঠির নলছিটি থানা পুলিশ ধাওয়া করে চালক জলিল সিকদারসহ কাভার্ডভ্যানটি আটক করে।

কিবরিয়ার অবস্থার অবনতি হওয়ায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় আনা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কিবরিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পরপরই তাকে জরুরি বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। মঙ্গলবার সকালে আইসিইউতে মারা যান গোলাম কিবরিয়া।

Bootstrap Image Preview