Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৭ শুক্রবার, মে ২০২৪ | ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

শিক্ষকদের গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল দেয় শিক্ষার্থীরা, প্রশংসাপত্র নিতে দিতে হয় ২০০ টাকা!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০১৯, ০৫:২১ PM
আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৯, ০৫:২১ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয় পরিকল্পিতভাবে। এরপর কয়েক গুণ টাকা নিয়ে সুযোগ দেওয়া হয় ফরম পূরণের। শিক্ষকদের দুপুরের রান্নার গ্যাস বিল এবং বিদ্যুৎ বিল দেয় শিক্ষার্থীরা। উপবৃত্তি, এমনকি পাশ করা শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র নিতে প্রত্যেককে দিতে হয় ২০০ টাকা করে।

এসবই অনিয়মই নিয়ম নড়াইলের কালিয়া উপজেলার যোগানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

টানা ২২ বছর ধরে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে নানা অনিয়মের মাধ্যমে টাকা আদায় করে আসছেন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এস এম আলমগীর হোসেন। কেবল সহকারী প্রধান শিক্ষকই নন, স্কুলের গাছ কেটে ভাগবাটোয়ারা, স্কুলের নামে অন্যের জমি দখলের পাঁয়তারা করছেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং প্রভাবশালী দুই সদস্য।

অত্যাচারে নিজের জমি হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটছে ৭০ বছরের সুখরঞ্জন সিকদারের পরিবারের। তাঁর জায়গা থেকে কয়েকটি গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষের নামে। ভয়ে মুখ খুলতে না পেরে কষ্টে তিন দিন না খেয়ে কাটিয়েছে পরিবারটি।

স্থানীয়দের অভিযোগ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহাবুবুল আলমের ছত্রছায়ায়ই ঘটছে এসব ঘটনা।

সরেজমিনে ওই বিদ্যালয়ে দেখা যায়, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে। সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসে আছেন স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আব্বাস আলী খান ও মিনহাজুর রহমান।

সাংবাদিক পরিচয় দিলে তেড়ে আসেন আব্বাস আলী। বলেন, সাংবাদিক এসে কী করবে, এর আগে কত সাংবাদিক আসলো, এটা স্কুলের ব্যাপার। আমরা ম্যানেজিং কমিটি যা ঠিক করবো তাই হবে। একপর্যায়ে স্থানীয় এমপির খুব কাছের লোক পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদন করলে শায়েস্তা করা হবে বলে হুমকি দেন।

স্থানীয়রা জানায়, ২০০৫ সালে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক মিয়ার সই জাল করে বিদ্যালয়ের দেড় লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আলমগীর। এ সময় আলমগীরের বাবা ছিলেন বিদ্যালয়ের সভাপতি।

এই অপবাদ সহ্য করতে না পেরে ওই প্রধান শিক্ষক স্ট্রোক করে মারা যান। ওই ঘটনায় আলমগীর কিছুদিন জেল খেটে আবার বেরিয়ে আসেন। এরপর থেকে আলমগীর শুরু করেন শিক্ষা বাণিজ্য।

কয়েক বছর আগে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচনে বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি মাহাবুবুল আলম জয়লাভ করেন। এতে বিপুল ক্ষমতার মালিক বনে যান সহকারী প্রধান শিক্ষক আলমগীর।

২০১৯ সালের এসএস সি পরীক্ষায় মোট ১৩৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। স্কুলের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অভিযোগ, নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১২৩ জনের মধ্যে ১০৬ জনকেই এসএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় বিভিন্নভাবে অকৃতকার্য দেখানো হয়।

এইসব অকৃতকার্যদের কারও একটি বিষয়ে আবার কারও চার বিষয়ে ফেল দেখিয়ে তাদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য চার হাজার ১০০ টাকা করে দিতে বাধ্য করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর মূল হোতা সহকারী প্রধান শিক্ষক আলমগীর। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত টাকা প্রদান করেও এসএসসি পরীক্ষায় অংশই নিতে পারেনি।

২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী রানা শেখ জানায়, চার হাজার টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করেও তার প্রবেশপত্র আসেনি। এ কারণে সে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তার অপরাধ সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাছে ফরম পূরণে বেশি টাকার হিসাব চেয়েছিল সে।

সদ্য পাস করা ছাত্র শাহিদ সিকদার জানায়, এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় তাকে তিন বিষয়ে ফেল করায়। চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম পূরণে চার হাজার ১০০ টাকা নেয়।
চর যোগানিয়া গ্রামের আরিফ, তাসলিমা খানম, পুকুরিয়া গ্রামের মারিয়া খানম, ডুমুরিয়া গ্রামের গনি মিয়াসহ অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীরা সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্কুলের পাশের একজন অভিভাবক নুরজাহান বেগম বলেন, আমার ছেলে রমজান আলীকে এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় চার বিষয়ে ফেল করিয়ে ফরম পূরণের সময় চার হাজার টাকা নিয়েছে। অথচ আমার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় পাঁচ বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে পাশ করেছে।

মেয়ে নিলমা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েকে উপবৃত্তি দেওয়ার কথা বলে দুই দফায় ৪০০ টাকা নিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় আমার মেয়ের বেতন ও পরীক্ষার ফি সবই দিতে হয়েছে। এই স্কুলে কোনো নিয়মই মানা হয় না।

২০১৯ সালে এসএসসি পাশ করা ছাত্র শাহিন হোসেন জানায়, কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রশংসাপত্র নিতে আসলে ২০০ টাকা চেয়েছেন আলমগীর স্যার। টাকা না দিলে তার প্রশংসাপত্র দেওয়া হবে বলে সাফ দেন। পরে বাধ্য হয়ে প্রত্যেকে টাকা দিয়ে প্রশংসাপত্র নিচ্ছে।

স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির অন্তত ১০ জন ছাত্রের সঙ্গে কথা বললে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলে, স্যাররা দুপুরে গ্যাসে রান্না করেন, সেই বাবদ ৫ টাকা এবং বিদ্যুৎ বিলসহ মোট ১০ টাকা নেওয়া হয় প্রত্যেকের বেতনের সঙ্গে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুলের উন্নয়নের নামে স্কুলের জমি থেকে নিয়মিত গাছ কেটে নেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। স্কুলের জমি থেকে নানা সময় কয়েক লাখ টাকার গাছ কেটে নিজের বাড়ির আসবাবপত্র বানিয়েছেন বর্তমান সভাপতি মাহাবুবুল আলম।

নড়াগাতি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালে নির্বাচনে জোরপূর্বক সভাপতি নির্বাচিত হয়ে স্কুলের সম্পদ ধ্বংসের পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন সহকারী প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে। এদের ভয়ে অভিভাবক এমনকি অন্য সদস্যরাও কথা বলতে পারেন না।

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দাতা সদস্য আমীর আলী বলেন, ভবন সংস্কারের নামে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন, বেঞ্চ ও চেয়ার তৈরির নামে বিদ্যালয়ের জমিতে থাকা বড় বড় গাছ বিক্রি করে পরিচালনা কমিটির সদস্য ও সহকারী প্রধান শিক্ষক ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন।

আমি কিছু বলতে গেলে ভয় দেখান। আমার অনুপস্থিতিতে সভার রেজুলেশনে আমার স্বাক্ষর জাল করেছে মাহাবুব আর আলমগীর। আপনার চলে গেলে আমাকে ওরা মারতে পারেন।

স্কুলের পাশের বাসিন্দা সুখরঞ্জন শিকদার (৭০) বলেন, আমার জমিতে লাগানো দুইটি মেহগনি গাছ কেটে নিয়ে গেছেন আব্বাস আলী খান ও মিনহাজুর রহমান। আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে আমার কোনো কথাই তারা শোনেননি। এখন তারা সব গাছ কেটে নেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। চেষ্টা চালাচ্ছেন আমার ওই জমি দখলেরও। কিছু বলতে গেলে হুমকি দিচ্ছেন।

নড়াগাতি থানা ছাত্রলীগ সভাপতি কে এম লালিফ হোসেন বলেন, নড়াগাতী থানা ছাত্রলীগের পদ ভাঙিয়ে মাহাবুবুল আলম ২০১৭ সালে যোগানিয়া ডি এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হন। এ সময় স্কুলের ২০টি গাছ এবং নড়াগাতী খালপাড়ের গাছ জবরদখল করে প্রায় ১৫ লাখ টাকার গাছ বিক্রি করেছেন, বাড়ির আসবাপত্র তৈরি করেছেন।

অভিযোগ বিষয়ে পরিচালনা কমিটির সদস্য আব্বাস আলী খান বলেন, বিদ্যালয়ে কোনো অনিয়ম হয় না। আমারা যে জমির গাছ বিক্রি করেছি ওই জমি বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য আব্দুল মমিন শেখ দান করে গেছেন। তাছাড়া ওই গাছ দিয়ে আমরা বিদ্যালয়ের একটি ভবন সংস্কার করেছি, বেঞ্চ তৈরি করেছি।

বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এস এম আলমগীর হোসেন অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ অন্যান্য ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রশংসাপত্রের জন্য ২০০ টাকা ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস বাবদ ১০ টাকা করে কেন নেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্যাসের বিল নেওয়া হয় না, তবে বিদ্যুৎ বিল বাবদ পাঁচ টাকা করে নেওয়া হয়। পরীক্ষায় ফেল করিয়ে টাকা আদায় এবং উপবৃত্তির ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারেননি অভিযুক্ত এই শিক্ষক।

যোগানিয়া ডি এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহাবুবুল আলম বলেন, স্কুলে অনেক আগে থেকে দুটি পক্ষ রয়েছে। আমি সভাপতি হওয়ার পর এখন শিক্ষকদের মধ্যে কোনো দলাদলি নেই। আপনার কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে এগুলো সবই প্রতিপক্ষের। তবে গাছ কেটে নেওয়ার কোনো ব্যাখ্যাই দেননি প্রভাবশালী এই নেতা।

যোগানিয়া স্কুলের শিক্ষা বাণিজ্য এবং অনিয়ম প্রসঙ্গে নড়াইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম সায়েদুর রহমান বলেন, বিদ্যালয়ের ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে। কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Bootstrap Image Preview