Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ শনিবার, মে ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

সোনাগাজীকে অপকর্মের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছিল ওসি মোয়াজ্জেম

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২২ জুন ২০১৯, ০৯:৫৯ AM
আপডেট: ২২ জুন ২০১৯, ০৯:৫৯ AM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ক্ষমতার দাপটে অন্যায় আর অত্যাচার ও ঘুষ-বাণিজ্যের রাজ্যত্ব তৈরি করেছিলেন। নিজেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাকব মাহবুবুল আলম হানিফের ভয় দেখিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদেরও বশ করে রাখতেন এই ওসি। একটি চক্রের মাধ্যমে থানায় বসে তিনি পুরো উপজেলায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। আইনের রক্ষক ও জনগণকে সেবা দিতে এসে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের অপকর্মের স্বর্গরাজ্য। অর্থ লেনদেন আর নিরীহ লোকদেরকে থানায় আটক করে ফাঁসানো ছিল তার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। 

রবিবার তার বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলায় ঢাকায় গ্রেফতার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন তার হাতে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা। অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করে তার বিরুদ্ধে তুলছেন নানা অভিযোগ। অভিযোগ ও মামলা করতে দিতে হতো হাজার টাকা আর জিডি করতেও টাকা নিতেন ওসি মোয়াজ্জেম।

স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, আইনের রক্ষক হয়ে কর্মক্ষেত্রে ওসি মোয়াজ্জেম সোনাগাজীতে জন্ম দিয়েছেন একের পর এক অপকর্ম। থানা থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ আর মামলার ভয় দেখিয়ে লোক ফাঁসানো ছিল তার নেশা। এই কাজে তাকে সোনাগাজীর একশ্রেণির প্রতারক চক্র তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করত। সাধারণ লোকজনকে বিনা কারণে থানায় আটক করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এছাড়া শহরের যান চলাচলসহ দোকানপাট, ইটভাটা, করাত কলসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীক স্থাপনা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।

ভুক্তভোগীরা জানান, ওসি মোয়াজ্জেম ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারিতে ওসি পদে সোনাগাজী মডেল থানায় যোগদান করেন। কিছুদিন পর তিনি আবুল খায়ের নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে অন্য জায়গা থেকে সোনাগাজী থানায় নিয়ে আসেন। এর পর তাকে দিয়ে সোনাগাজী বাজারের বিভিন্ন দোকান, ইটভাটা, যানবাহনসহ বেশকিছু ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। ওসির নাম দিয়ে আবুল খায়ের বিনা কারণে নিরীহ লোকদেরকে থানায় ধরে এনে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে থানায় এনে নির্যাতন ও হাজতে আটক রেখে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন ওসি মোয়াজ্জেম। তিনি আবুল খায়েরকে দিয়ে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরকে থানায় ডেকে এনে তাকে মাসিক চাঁদা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। অন্যথায় থানায় আটক করে মাদক দিয়ে জেল হাজতে পাঠানোর হুমকি দিতেন ওসি। তার অত্যাচার ও হয়রানি থেকে বাঁচতে উপজেলা সিএনজি চালিত অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে ৫০ হাজার, ৩০টি হিউম্যান হলার (ইমা) গাড়ি থেকে মাসিক ৩০ হাজার, উপজেলার ছয়টি ইটভাটা থেকে মাসিক ২০ হাজার করে, উপজেলা সদরে চলতে হলে টমটম প্রতিগাড়ী মাসিক তিনশ টাকা, ব্যাটারি চালিত রিকশা প্রতি দুইশত টাকা, মাইক্রোবাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে মাসিক বিশ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিতেন ওসি মোয়াজ্জেম।

এছাড়া পৌর শহরের ইলেক্ট্রনিক্সসহ বিদেশি বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির তিনটি দোকান থেকে প্রতি মাসে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা নিতেন ওসি মোয়াজ্জেম। সরকারী ভাবে দোকানে পলিথিন রাখা ও বিক্রয় করা নিষিদ্ধ। কিন্তু সোনাগাজী পৌরশহরের ৪২টি দোকানের মালিক পলিথিন বিক্রি বাবত ওসি মোয়াজ্জেমকে এককালীন ৩০ হাজার এবং প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা করে দিতে হতো। শুধু তাই নয় পৌরশহর ও উপজেলার বিভিন্ন খোলা বাজারে যেসব দোকানে ডিজেল, অকট্রেন, পেট্টোল বিক্রি করা হত। তাদেরকেও প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ওসিকে চাঁদা দিতে হতো। উপজেলায় সব কয়টি করাত কল থেকে মাসিক দশ হাজার টাকা করে চাঁদা নিতেন ওসি। এমনকি উপজেলার কোথাও কোন জমির মালিক মাটি বিক্রি করলে তাকে চাঁদা দেওয়া ছাড়া কোন ভাবে মাটি কাটা যেত না। সোনাগাজীতে বড় ফেনী ও ছোট ফেনী নদীতে দুটি বালু মহাল রয়েছে। দুটি বালু মহাল থেকেও ওসি মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে চাঁদা নিতেন। এসব বিষয়ে সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠানের মালিক পুলিশী হয়রানির ভয়ে কথা বলতে না চাইলেও প্রতিবেদকের কাছে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মালিকরা এসব তথ্য দিয়েছেন।

ওসি মোয়াজ্জেমের হাতে নির্যাতনের শিকার জয়নাল আবেদিন নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি ফেনী শহরে চাকুরী করেন। তার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে এক ব্যক্তির বিরোধ ছিল। সে বিরোধকে কেন্দ্র করে গত বছর নভেম্বর মাসে তিনি ফেনী থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে থানার সামনে থেকে তাঁকে আটক করে থানা হাজতে বন্দি করে রাখেন। রাত প্রায় দুইটার দিকে ওসিকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে তিনি থানা থেকে ছাড়া পান।

একই ভাবে উপজেলার মদিনা বাজার এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসলাম সবুজ জানান, জমির নথির একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ওসি মোয়াজ্জেম তাকে থানায় ডেকে নিয়ে তিনদিন আটক রেখে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকার একটি লিখে নেন। পরে পরিবারের সদস্যরা তাকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন।

উপজেলার চর চান্দিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য নুর নবী বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম দালালদের কথা শুনে বিনা কারণে তাকে থানায় ধরে নিয়ে দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টাকা না দিলে তাঁকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন ওসি।

উপজেলার মনগাজী বাজারের ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম জানান, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কলেজ রোড থেকে ওসির ক্যাশিয়ার আবুল খায়ের তাঁকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। পরে তার বিরুদ্ধে হুন্ডি ব্যবসার অভিযোগ তুলেন। দুদিন থানায় আটক থাকার পর ওসি মোয়াজ্জেমকে দুই লাখ টাকা দিলে ছাড়া পান তিনি।

পৌর শহরের সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক দেলোয়ার হোসেন জানান, নাম্বার বিহীন সিএনজি সোনাগাজীতে চালাতে হলে ওসি মোয়াজ্জেমকে এককালিন দশ হাজার টাকা দিয়ে একটি টোকেন নিতে হতো এবং প্রতি মাসে ৫শ টাকা করে দিতে হতো। না দিলে গাড়ী থানায় আটক রেখে হয়রানি করতো।

চর খোন্দকার এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মো. বাদল জানান, জমি ক্রয়-বিক্রয়ের একটি ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে থানায় একটি অভিযোগ ছিল। সে অভিযোগের ভিত্তিতে ওসি মোয়াজ্জেম পুলিশ দিয়ে তাঁকে থানায় ধরে নিয়ে দুই দফা চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন মোয়াজ্জেম গ্রেফতার হওয়ায় তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

একই ভাবে সোনাগাজী পৌরশহরের ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানান, ভূমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে ওসি মোয়াজ্জেম তাঁকে থানায় ডেকে নিয়ে তিনদিন হাজতে আটক করে রাখেন। পরে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান।

উপজেলার সোনাপুর এলাকার বাসিন্দা পাখি আক্তার জানান, ওসি মোয়াজ্জেমকে দুই লাখ টাকা না দেওয়ায় তাঁর এক ছেলেকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে অস্ত্র দিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ওসি মোয়াজ্জেমের শাস্তির দাবি করেন।

স্থানীয় মানবাধিকার নেতা কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম সোনাগাজীতে যোগদান করেই আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল আলম হানিফের ভাগিনা পরিচয় দিয়ে ত্রাসের রাজ্যত্ব কায়েম করেন। থানায় আইনী সহায়তা নিতে আসা লোকজনকে আইনী সেবা না দিয়ে চাঁদাবাজি ও হয়রানি শুরু করেন। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও তার কাছে জিম্মি ছিল। এখন ওসি মোয়াজ্জেম গ্রেফতার হয়ে জেল হাজতে রয়েছেন। তার হাতে অত্যাচার-নির্যাতন ও চাঁদাবাজির শিকার হওয়া অনেক লোক তার বিরুদ্ধে মামলা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।

নুরুল ইসলাম জানান, ওসি মোয়াজ্জেম পুনরায় তার কাছে নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর হাজতে রেখে দিতে বলেন। রাত দুইটার দিকে হাজত থেকে আবুল খায়ের তাঁকে বের করে আবার ওসির কাছে নিয়ে যায়। ওসি তাঁর বিরুদ্ধে হুন্ডি ব্যবসার অভিযোগ আছে বলেন। এরপর ওসি তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে দুই লাখ টাকার দাবি করেন। তখন নুরুল ইসলাম বলে আমি কোন অবৈধ ব্যবসা করি না। আর আমার কাছে এত টাকা নাই। আমি গরীব ঘরের সন্তান। বাড়ি বিক্রি করলেও দুই লাখ টাকা হবে না। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোট্ট একটি চায়ের দোকান করে সংসার চালায়। দুই লাখ টাকা না দিয়ে তাকে অবৈধ চোরাচালানীর সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে এবং জামায়াতের মামলায় জেল হাজতে পাঠানোর হুমকি দেন ওসি।

উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রবিউজ্জামান বলেন, ওসি মোয়াজ্জেমের কুটকৌশলের কাছে জনপ্রতিনিধিরাও অসহায় ছিল। সোনাগাজীতে এমন কোন জায়গা নেই যে খান থেকে তিনি চাঁদা নেননি। সাধারণ লোকজনকে থানায় ধরে এনে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করে টাকা আদায় করেছেন। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকেও তিনি ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। থানায় বিচার চাইতে গেলে কার প্ররোচনায় ওসি নুসরাতে ভিডিও ধারণ করেছেন তিনি সেটিও খুঁজে বের করার দাবি জানান।

জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধরণ সম্পাদক ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল আরেফিন বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম সোনাগাজীর জন্য একটি কলঙ্কিত নাম। তিনি যোগদানের পর চাঁদাবাজির কারণে উপজেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিত অবনতি হতে থাকে। সাধারণ লোক থেকে শুরু করে সিএনজি চালকসহ দোকানদারদের থেকেও তিনি চাঁদা আদায় করেছেন। 

তিনি বলেন, জনগণের কাছে পুলিশ বাহিনীর যে সম্মান ছিল। ওসি মোয়াজ্জেমের অপকর্মের কারণে তা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি থানাকে একটি দালাল ও চাঁদাবাজদের আস্তানায় পরিনত করেছিলেন। এ কারণে জনপ্রতিনিধিরা জরুরী প্রয়োজন ছাড়া থানায় যেতেন না।

তিনি আরো বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম নিজেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার ভাগিনা পরিচয় দিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকেও জিম্মি করে রাখতেন। এখন ওসি মোয়াজ্জেম গ্রেফতার হওয়ায় তাঁর হাতে অত্যাচার-নির্যাতন ও চাঁদাবাজির শিকার হওয়া ব্যক্তিরা খুশি হয়েছেন।

সোনাগাজী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার বর্তমানে ফেনী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, তিনি সোনাগাজীতে দায়িত্বে থাকাকালে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে কেউ হয়রানির কারার কোন অভিযোগ করেননি। কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। তবে একজন ওসির বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ ওঠা দুঃখজনক।

জানতে চাইলে ফেনীর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান ওসি মোয়াজ্জেমের কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Bootstrap Image Preview