Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১০ শুক্রবার, মে ২০২৪ | ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

বেরিয়ে আসছে রুহুল আমিনের নানা অপকর্মের কাহিনী

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ১২:০৮ PM
আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ১২:০৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় গ্রেফতার রুহুল আমিনের ক্ষমতার দাপট ও অপরাধের নানা তথ্য উঠে আসছে। সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি তিনি। দীর্ঘদিন ধরে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে আসছিলেন সোনাগাজীতে। 

গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত শ্নীলতাহানির অভিযোগ আনার পরপরই ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন রুহুল। ওই দিনই সোনাগাজী উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম ভূঁইয়া ও পৌর কাউন্সিলর বিএনপি নেতা মো. ইয়াছিনকে নিয়ে মাদ্রাসায় গিয়ে বিষয়টি মিটমাট করতে বৈঠক করেছিলেন তিনি। 

এরই মধ্যে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তার রাজনৈতিক উত্থান থেকে শুরু করে নুসরাতের ঘটনায় ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে নানা চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে তার ব্যাপারে। এ ছাড়া গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সোনাগাজীতে খোঁজ নিয়ে নানা অপকর্মের কাহিনী পাওয়া গেছে তার।

এদিকে, গত শুক্রবার পিবিআইর হাতে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে রুহুলকে। এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তবে হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।

স্থানীয় ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের কেরানিবাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। একসময় জাহাজের কুলি ছিলেন বাবা। পড়াশোনায় পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পার করতে পারেননি তিনি। আওয়ামী লীগে যোগ দেন ১৯৯৭ সালে। সৌদি আরবে অবস্থান করেন ২০০১-০৯ সাল পর্যন্ত। ট্যাক্সি চালান সেখানে। সৌদিতে থাকাকালীন গোপনে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন আবার। অনেক দেনদরবার করে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সদস্য হন ২০১৩ সালে। 

এরপর ২০১৬ সালে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হন নিজাম হাজারীর আশীর্বাদে। সভাপতি নির্বাচিত হন ২০১৮ সালে।

২০১৫ সালে হঠাৎ সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। তখন থেকেই সোনাগাজীতে নানা অপকর্ম শুরু করেন রুহুল আমিন। এর পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

জানা গেছে, রুহুলের তিন ভাই। এক ভাই আবুল কাশেম ওরফে রাইফেল কাশেম। তিনি পৌর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। আরেক ভাই সুফিয়ান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তিনিও সেখানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ নেতা হলেও স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে তার। ফৌজদারি অপরাধ করেও অনেক বিএনপি নেতাকে প্রভাব খাটিয়ে মামলা থেকে রক্ষা করেছেন তিনি। 

২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত রায় ঘোষণা করলে সোনাগাজীতে মিছিল বের করে স্থানীয় বিএনপি। পুলিশ এতে বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে। পরে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলেও মিছিলে নেতৃত্বদানকারী উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম ভূঁইয়াকে আসামি করা হয়নি। অভিযোগ আছে, তদবির করে ওই মামলা থেকে তাকে বাঁচিয়েছেন রুহুল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার নানা দুর্নীতি ছাড়াও জমি দখল, পদবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অনেক অপরাধে জড়িত রুহুল আমিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। অবৈধ বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। পরে মামলা প্রত্যাহার করা হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, রুহুলের হয়ে সোনাগাজী থানায় দেনদরবার করতেন তার বিশ্বস্ত দুই সহযোগী যুবলীগ নেতা আবদুল হালিম ও পৌর যুবলীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন অপু। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন খন্দকার ও আইয়ুব আলী ফরহাদ। এলাকায় সব বড় সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে নির্ধারিত কমিশন চলে যেত রুহুলের পকেটে।

ফেনীর জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফয়েজুল কবির বলেন, কোনো কাউন্সিল ছাড়াই রুহুল সভাপতি হয়ে গেছে। হঠাৎ একদিন দেখলাম, সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমার নাম নেই।

কীভাবে কারা এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আপনারা বুঝে নেন। এটা নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না।

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ব্যক্তির অপরাধে দায় তার নিজের। নুসরাতের ঘটনার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ এর নিন্দা জানিয়েছে। ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের অধিকাংশ জামায়াত-শিবির।

এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ সেলিম বলেন, সোনাগাজীতে এখন যারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, তাদের অধিকাংশ নব্য আওয়ামী লীগ নেতা। রুহুল হঠাৎ নেতা বনে গেছে। তার দুই ভাই বিএনপির ক্যাডার। টেন্ডার-বাণিজ্য, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে এমন কোনো ব্যবসা নেই, যেটা এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাদের কাছে দল বা আদর্শ মুখ্য নয়; টাকাই তাদের কাছে মুখ্য। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি নিজাম হাজারীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব অপকর্ম চালিয়ে আসছিল রুহুল। ৩০-৪০ বছর ধরে যারা আওয়ামী লীগ করছে, অনেক দিন সোনাগাজীতে কোণঠাসা তারা।

দলের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, সোনাগাজী থানায় সালিশ ও তদবির বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রুহুল আমিনের ক্যাডাররা। আওয়ামী লীগের নেতা হলেও বিএনপি-যুবদলের ক্যাডারদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। এদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি নেতা খুরশিদ আলম, রুহুলের চাচাত ভাই চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াধন ও তার ২০-২৫ জনের ক্যাডার বাহিনী। তার বাহিনীতে আরও রয়েছেন ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার দুলাল ওরফে বাটা দুলাল, ইয়াবা বিক্রেতা হেলাল, সিরাজ ওরফে সিরাজ ডাকাত, আবুল কাশেম ওরফে কাশেম মাঝি, সাবমিয়া, ফকির বাড়ির গোলাপ, আব্দুল হালিম ও সোহেলসহ কয়েকজন। এদের হাতে বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। 

এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য আবুল কালাম বাহারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তার ক্যাডাররা। সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা স্বপন, চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ, মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নূরুজ্জামান লিটনসহ অনেকে বিভিন্ন সময় রুহুল আমিনের বাহিনীর হাতে মারধরের শিকার হন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা হওয়া সত্ত্বেও রুহুলের অনুগত না হওয়ায় সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবসার, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপতথ্য সম্পাদক আব্দুর রহিম খোকনসহ কয়েকজনকে পদ থেকে বাদ দেয়া হয়। এদের অনেকে এখন দলে নিষ্ক্রিয়। 

সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার সূত্র জানা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সোনাগাজী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন ওই মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ৬-৭ মাস আগে নানা কৌশলে শেখ মামুনকে বাদ দিয়ে রুহুল আমিন সদস্য মনোনীত হন। এক্ষেত্রে নুসরাত যৌন নির্যাতনের হোতা ওই মাদ্রাসার বরখাস্তকৃত সিরাজ উদ দৌলা নানা অপকর্ম ধামাচাপা দিতে চেষ্টা চালায়। এজন্য তিনি নুসরাতে পরিবারকে নানাভাবে হেনস্তা করেন। কিছুদিনের মধ্যেই রুহুল ওই মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি হয়ে যান। মাদ্রাসার মার্কেটের ১২টি দোকান, ভেতরের বিশাল পুকুরের মাছ চাষ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপায়ে আদায় করা বাড়তি টাকার ভাগ পেতেন রুহুল আমিন ও আরেক সদস্য কাউন্সিলর মাকসুদ। ক্যাম্পাসের বাইরে মাদ্রাসার রয়েছে জমিসহ কোটি টাকার সম্পদ। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসার কয়েক শিক্ষক জানান, অধ্যক্ষ সিরাজ প্রায়ই বলতেন, রুহুল, মাকসুদ এরা সবাই অশিক্ষিত। এদের সুবিধা দিয়ে আমাদের পক্ষে রাখতে হবে। এরা থাকলে দুই রকম সুবিধা। একদিকে এরা কোন বিষয়ে উচ্চবাচ্য করবে না। আবার সবসময় আমাদের পক্ষেও থাকবে। 

জানা গেছে, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার নানা দুর্নীতি ছাড়াও জমি দখল, পদবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অসংখ্য অপরাধে জড়িত রুহুল আমিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। অবৈধ বালু উত্তোলনে বাধা দেয়ায় ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসির বিরুদ্ধে মামলা করেন রুহুল আমিন। পরবর্তীতে মামলা প্রত্যাহার করেন। দলের প্রভাব খাটিয়ে পদ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একইভাবে সোনাগাজী উপজেলার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। দলের প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার চরচান্দিায়া পূর্ব বড়ধলি মৌজায় শতাধিক ভূমহীনদের জমি দখল করেন রুহুল আমিন। 

দলীয় সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়েজ কবির স্বপদে বহাল থাকা অবস্থায় রুহুল আমিন কীভাবে সভাপতি হলেন তা অনেকেই জানেন না। ফয়েজ কবির উপজেলা সভাপতি হিসেবে ফেনী জেলা পরিষদে প্রথমে সদস্য ও পরে প্যানেল চেয়ারম্যান হন। 

ফয়েজ কবির জানান, আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করিনি। আবার আমাকে বাদও দেয়া হয়নি। তাহলে অন্য কেউ কীভাবে এ পদের পরিচয় দিতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। রুহুল আমিন কীভাবে সভাপতি হলেন আমি জানি না। তবে এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি। 

এ ব্যাপারে সাবেক এমপি রহিম উল্যাহ জানান, আমি ও ডাক্তার গোলাম মাওলা সোনাগাজী শহীদ ছাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু সোনাগাজী বাজারের পশ্চিমাংশের একটি পক্ষ হঠাৎ করে রুহুল আমিনকে সেখানে নিয়ে যায়। পরে অভিভাবক সদস্যসহ কয়েকজন সদস্যকে চাপ প্রয়োগ করে তাকে সভাপতি করতে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান রুহুলকে সভাপতি মনোনীত করলেও আমি আর সভাপতির চেয়ারে বসতে পারিনি। রুহুল আমিন ও তার লোকজন দফায় দফায় আমার ওপর হামলা চালায়।

Bootstrap Image Preview