Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ রবিবার, মে ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নারীর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতন মানবাধিকারের লঙ্ঘন

নারী ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০১:৫৫ PM
আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০২:৪০ PM

bdmorning Image Preview


৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বা স্লোগান যা-ই হোক না কেন, এর মর্মবাণী হচ্ছে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ব্যক্তি ও জনজীবনে  নারী পূর্ণ মানব সন্তানের স্বীকৃতি, অধিকার, মর্যাদা পাবে। ১৯০৭ সালে বিশ্ব নারী আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেতকিন একটি দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, সুপারিশ পেশ করেছিলেন।  বিশ্ব নারী আন্দোলনের এই আহ্বান ১৯০৭ সালে অল্পসংখ্যক রাষ্ট্রনেতা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আজ ২০১৯ সালে অর্থাৎ ১১২ বছর পর জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত ১৯৮টি দেশসহ সারা বিশ্বে রাষ্ট্রীয়, সামাজিকভাবে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০১৯ সালে নারী দিবস পালন হচ্ছে এমন এক সময়, যখন শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় নানা উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে ঘোষণা করা হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নামে (SDG) একটি কর্মসূচি, যে কর্মসূচিটিতে অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় ঘটানোর প্রচেষ্টা হয়েছে। ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে মোটাদাগে বিরাজমান ব্যবধান কমিয়ে আনার কিছুটা প্রচেষ্টা হয়েছে। লিঙ্গীয় বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে লিঙ্গীয় সমতার বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। 

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পর্ব ছাড়িয়ে শিল্পায়নের অর্থনীতি গড়ে তোলার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কৃষি অর্থনীতি-উত্তর শিল্পায়িত সমাজের সব ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অগ্রসরমাণ। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বাড়ছে দ্রুত ও তীব্র মাত্রায়। অর্থনীতির পশ্চাৎপদতা কাটতে থাকলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনোজগতের ক্ষেত্রে বিরাজমান  রয়েছে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা। বিশেষ করে নারীর প্রতি নীচ, হীন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এসব দুর্ভাবনা নিয়েই আমরা পালন করব নারীর অধিকার, মর্যাদা রক্ষার কর্মসূচি। উচ্চ স্বরে আওয়াজ তুলব নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন।

২০১৮ সালটি ছিল যথেষ্ট জটিল ও উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের একটি মৌল কর্মসূচির বিপক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি নীতি ঘোষিত হয়েছে। সেটি হলো সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিটি। অন্যদিকে আমরা লক্ষ করছি কোনো রাজনৈতিক দল, শক্তি, ব্যক্তি কেউ  এর বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর দেড় সহস্রাধিক নারী ফরম নিলেন। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে সংসদে আসার প্রবল আগ্রহ। এই দুটি কর্মসূচি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পাশাপাশি আরেক চিত্র—নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে—এটাই ছিল ২০১৮-এর চিত্র। এই সময় সামাজিক আন্দোলন, সামাজিক বিকাশ ও আইনগত দিক দিয়ে নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে তেমন সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। সমাজ, রাষ্ট্র ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যথার্থ সমন্বয় ও দ্রুত শক্তিশালী ভূমিকার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

ব্যাংক, কলকারখানা, প্রশাসন ও বিভিন্ন অর্থকরী পেশায় যে ব্যাপকসংখ্যক নারী ক্রমবর্ধমান হারে অংশগ্রহণ করছে, ভূমিকা রাখছে, তথা সব নারীর দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান ভূমিকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সামাজিক বিকাশের যে বাস্তব ভিত্তি তৈরি করছে, এটা দেশ-বিদেশের গবেষক, সমাজচিন্তক সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। আজ সরকার ও রাষ্ট্রের প্রয়োজন অর্থনৈতিক, সামাজিক বিকাশের এই ধারায় জড়িত নারী জনগোষ্ঠীর অব্যাহত ভূমিকাকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সাহায্য প্রদান করা, নিরাপত্তাব্যবস্থাকে জোরদার করা, বিদ্যমান নারীবিদ্বেষী পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করা। আর সে জন্যই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তথা বাংলদেশের নারী আন্দোলন গৃহায়ণ, যাতায়াত ও দিবা শিশু রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা বিষয়টিকে অতি জরুরি হিসেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। আর এখানেই লক্ষ করা যাচ্ছে যে বর্তমান সরকার এ বিষয়গুলোতে যতটুকু মৌখিকভাবে বলছে, বাস্তবে ততটুকু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। যেমন যাতায়াত ও শিশু রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র। এটা সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেই করতে হবে। তবে এটা ঠিক যে পেশাজীবী নারীদের আবাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে এবং রাখা দরকার।

৩.

নারীর মানবাধিকারের মৌল একটি বিষয় সর্ব প্রকার সহিংসতা, নিষ্ঠুর আচরণ, শারীরিক, মানসিক নিপীড়নমুক্ত একটি জীবন। বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের শতাব্দীর সংগ্রামী ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও এখনো নারীর ন্যূনতম বেশ কিছু মৌল অধিকার অর্জিত হয়নি। পরিবারে তথা গৃহে, কর্মক্ষেত্রে, যানবাহনে, রাস্তাঘাটে সর্বত্র নারী দৈহিক, মানসিক সর্ব প্রকার সহিংসতা ও নিষ্ঠুর আচরণ ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গবেষণা ও নিরীক্ষামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের নারীরা গৃহে ৮৭ শতাংশ নির্যাতন বা সহিংসতার শিকার হয়। এ নির্যাতন জীবনসঙ্গী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের দ্বারা হয়ে থাকে। পাশাপাশি আরো কতক শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আমাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রশিক্ষণ গবেষণা পাঠাগার উপ-পরিষদের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে  নারী  ও কন্যা নির্যাতন নিয়ে একটি নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাতেও নারী ও কন্যা নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়েছে।

সারা বিশ্বে একটি শব্দ আজ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে সেটি হচ্ছে (Gender equality) লিঙ্গীয় সমতার ইস্যুটি। বিশ্ব বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেক আগেই এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, একবিংশ শতাব্দী হতে হবে নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকারের শতাব্দী। ২০১৮-এর চলমান চিত্র এটাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই শতাব্দীর শতমুখী বাধার দেয়াল ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি নারীর প্রতি সর্ব প্রকার সহিংসতাও চলছে।

এ সময় দেখা যাচ্ছে যে  ২০১৯-২০-২১ এই বছরগুলো হবে বেশ কয়টি জাতিসংঘ উদ্যোগের ও বিশ্ব নারী আন্দোলনের বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডের ফলাফল মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার সময়। যেমন—জাতিসংঘের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের (১৯৯৫) ২৫ বছর পূর্তিতে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে ঘোষিত ১২টি কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং কী ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করছে বিশ্ব নারীর জীবনে, তা মূল্যায়নের কর্মসূচি। জাতিসংঘ সিডও সনদ (১৯৮১) বাস্তবায়ন, অনুমোদন কিভাবে হচ্ছে তার মূল্যায়নের সময়। এসব মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে প্রত্যেক দেশের নিজস্ব জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা।

আজ আমরা আরেকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিপর্যয়মূলক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, সেটি হচ্ছে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা। রাজনৈতিক বিরোধপূর্ণ দেশগুলো থেকে শত-সহস্র নারী-শিশু ইউরোপ বা আশপাশের দেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তা মানবসভ্যতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। অন্যদিকে অভিবাসন (Migration) প্রক্রিয়া, অভিবাসী এ প্রসঙ্গটি নিয়েও আজকে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাগরিকদের মনে নানা প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। ইউরোপীয় নবজাগরণে মানবিকতা যুক্তিবাদের আলোকে মানবসমাজে যে নতুন সভ্যতার উদয় হয়েছিল, সেখানে আজ নানা পশ্চাৎপদ চরম প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্বজনীন ভাবনা আজ এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। মানবতাবাদ ও উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেই এ সমস্যা সমাধানের পথে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অগ্রসর হতে হবে বলে নারী আন্দোলন মনে করে।

পরিবারে নারীর যে কাজ ও ভূমিকা, পরিবারে নারী যে দেখাশোনা, সন্তান লালন-পালন ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজের দায়িত্ব পালন করেন, এই পুরো বিষয়টিই ঐতিহাসিকভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যায়নে আনা হয় না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলি, এখন নারীর এই ভূমিকাকে বিশেষ সূচকে মূল্যায়ন করে যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আরো মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ‘Recognition of Women’s Unacounted Work’ শীর্ষক গবেষণা আলোচনায় সমাজচিন্তক নারীবাদী গবেষকদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে জোরেশোরে এই দাবি আসছে।

দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর নারী, মানবাধিকার আন্দোলনের ইতিবাচক ফল হিসেবে বিশ্ব নারী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অর্জন লাভ করল একটি স্লোগানের মাধ্যমে। সেটি হলো, ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন।’ বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড করেও বাংলাদেশে নারী, কন্যা নির্যাতন ও সহিংস আচরণ বন্ধ করতে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রমাণ আমরা লক্ষ করিনি। যদিও অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও সমাজের মূলধারায় সক্রিয় ও সরব উপস্থিতির ক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে চলার উল্লেখযোগ্য দৃশ্য বাস্তবে বিদ্যমান। পেশাদারি দক্ষতা অর্জনেও সাফল্য লক্ষ করা যায়। এসব অর্জন ও সাফল্যের পাশাপাশি ২০১৮ সালের বাংলাদেশে নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতি একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই দেখা যায়, বিশাল এক অসংগতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান। একটা মৌলিক ও বিপরীত বা বিরোধপূর্ণ বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা হই। সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলধারার কতক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চালকের ভূমিকায় রয়েছে নারী। তথাপি নারীর মানবাধিকার তথা একজন পূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তার স্বীকৃতি আইনিভাবে, পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে এখনো বাস্তবে স্বীকৃত হচ্ছে না। এই ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের সময় বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের এ বিষয়টি জরুরিভাবে ভেবে দেখতে হবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

Bootstrap Image Preview