Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২২ বুধবার, মে ২০২৪ | ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

জাহালমকে ফাঁসানোর পেছনে যে আটজন দায়ী 

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ মার্চ ২০১৯, ০৯:৪৩ AM
আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯, ০৯:৪৩ AM

bdmorning Image Preview


টাঙ্গাইলের বিনা অপরাধে জাহালমের কারাভোগ নিয়ে দুদকের তদন্তেই এই আটজনের নাম উঠে এসেছে। তারা জাহালমকে প্রতারক আবু সালেক নামে শনাক্ত করেছিলেন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জাহালমকে আসামি করে আদালতে ২৬ মামলার চার্জশিট পেশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এই বিষয় দুদক পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি আজ-কালের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে পেশ করবে। তদন্ত প্রতিবেদনটি উচ্চ আদালতেও জমা দেওয়া হতে পারে। 

সূত্র থেকে জানা গেছে, বিনা অপরাধে জাহালমের কারাভোগের খবর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে প্রচারিত হলে দুদক অভিযোগ অধিকতর তদন্ত করে জাহালমের নাম বাদ দিয়ে আসামি হিসেবে আবু সালেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করে ২৬ মামলার সম্পূরক চার্জশিট আদালতে পেশ করে। ওই সময় কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী দুদকের আইনজীবীরা জাহালমের জামিনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন।

এ সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনি প্রক্রিয়ায় জাহালমের জামিনের চেষ্টা চালাতে থাকে। এরই মধ্যে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বেআইনিভাবে জেল খাটার খবর প্রকাশ হলে জাহালমের মুক্তির তোড়জোড় শুরু হয়। একপর্যায়ে হাইকোর্টের নির্দেশে এক মাস আগে জাহালম মুক্ত হন। 

ভুল শনাক্ত করে জাহালমকে যারা ফাঁসিয়েছেন: মামলার তদন্ত পর্যায়ে পুলিশ জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে গ্রেফতার করে দুদকে সোপর্দ করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জাহালমকে রাখা হয়েছিল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে। ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর চার ব্যাংক কর্মকর্তা ও দুই গ্রাহক সশরীরে দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অসহায় জাহালমের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে প্রতারক আবু সালেক বলে চিহ্নিত করেন। একইভাবে দুই গ্রাহক জাহালমকে আবু সালেক বলে শনাক্ত করেছেন। দুদকের সংশ্নিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে স্বাক্ষর নিয়েছেন। এটা প্রতিটি মামলার চার্জশিটের নথিতে যুক্ত করা হয়েছে। 

ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের শনাক্তকরণের আগে দুই ইউপি চেয়ারম্যান দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে আবু সালেকের ছবি দেখে জাহালম বলে শনাক্ত করেছেন। তারা তাদের ইউটি প্যাডে শনাক্তকরণ প্রত্যয়ন করে স্বাক্ষর করেছেন। তাদের ওই প্রত্যয়নপত্রও চার্জশিটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। 

শনাক্তকারী চার ব্যাংক কর্মকর্তা: ব্র্যাক ব্যাংকের ঢাকার মোহাম্মদপুরের এসএমই শাখার কর্মকর্তা ফয়সাল কায়েস জাহালমের বাড়ি ও ঘোড়াশাল জুট মিল সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং দুদকের প্রধান কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে হাজির হয়ে আটক জাহালমকে আবু সালেক বলে শনাক্ত করেন। তিনি সালেকের এই এসএমই শাখায় ব্যাংক হিসাবের পরিচয় প্রদানকারী। একই ব্যাংকের মোহাম্মদপুর এসএমই শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক সাবিনা শারমিন ঘোড়াশাল জুট মিল সরেজমিন পরিদর্শন শেষে দুদকে হাজির হয়ে জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেন। তিনি ওই এসএমই শাখায় সালেকের ব্যাংক হিসাবের অনুমোদনকারী। 

সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা বিভাগ-১-এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার নুরুদ্দিন শেখ দুদক মিডিয়া সেন্টারে হাজির হয়ে জাহালমকে আবু সালেক বলে শনাক্ত করেছেন। তিনি আবু সালেকের সোনালী ব্যাংকের মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার হিসাবটির অনুমোদনকারী। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখার কর্মকর্তা (ক্যাশ) তাজবিন সুলতানাও দুদকে হাজির হয়ে জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেন। তিনি তার ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখায় সালেকের হিসাবের পরিচয় প্রদানকারী।

দুই গ্রাহক: সোনালী ব্যাংকের মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখায় সালেকের খোলা হিসাবের পরিচয় প্রদানকারী ও সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক সহিদুল ইসলাম দুদকে হাজির হয়ে আটক জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেছেন। সিটি ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখায় সালেকের হিসাবের পরিচয় প্রদানকারী এই ব্যাংকের গ্রাহক মো. সাকিলও অন্যদের মতো দুদকে হাজির হয়ে জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেন। 

দুই ইউপি চেয়ারম্যান: টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সলিমাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম মন্টু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে সালেকের ছবি দেখে জাহালম বলে শনাক্ত করেন। একই জেলার নাগরপুরের ধুবুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান খান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে সালেকের ছবি দেখে জাহালম বলে শনাক্ত করেন। তারা দু'জনই তাদের ইউপি প্যাডে শনাক্তকরণ প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। 

জানা গেছে, বিনা অপরাধে জাহালমের তিন বছরের কারাভোগের ঘটনার বিচার শুরু হয়েছে হাইকোর্টে। উচ্চ আদালতে আজ এ ঘটনার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আদালত দেখবেন আসামি না হয়েও ২৬ মামলায় কেন তিন বছর কারাভোগ করেছেন জাহালম। 

দুদকের ৯ তদন্ত কর্মকর্তা সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ৩৩টি মামলা তদন্ত করে ২৬টি মামলার চার্জশিটে জাহালমকে আসামি করেন। 

সূত্র থেকে আরো জানায়, দুদকের উপ-পরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) আবদুল্লা-আল-জাহিদ বাদী হয়ে সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রতারক আবু সালেককে আসামি করে ৩৩টি মামলা করেছিলেন ২০১২ সালে। পরে দুদকের ১০ তদন্ত কর্মকর্তা ৩৩ মামলা তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট পেশ করেন। এর মধ্যে ৯ তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্নিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা, গ্রাহক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২৬টি চার্জশিটেই আবু সালেকের নাম বাদ দিয়ে জাহালমের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। 

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, বিনা অপরাধে জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় এরই মধ্যে হাইকোর্ট জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও ভুল তদন্তের সঙ্গে জড়িত তদন্ত কর্মকর্তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে দুদকের প্রতি রুল জারি করেছেন। দুদক থেকে শিগগির ওই রুলের জবাব দেওয়া হবে। জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় আজ হাইকোর্টে আবার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। 

দুদক জানায়, ২৬টি চার্জশিটে নিরপরাধ জাহালমের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ভুলটি তাদের কাছে ধরা পড়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। এর পরই দুদক কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে জরুরি সভা হয়। পরে মালমাগুলোর অধিকতর তদন্ত করা হয়। এ পর্যায়ের তদন্তে জাহালম নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হন। ওই ভুল সংশোধন করে গত জানুয়ারিতে আদালতে দ্বিতীয় পর্যায়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে ২৬ মামলার চার্জশিটে জাহালমের নাম বাদ দিয়ে আবু সালেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। 

জানা গেছে, অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার পর জাহালমের জামিনে কোনো ধরনের বিরোধিতা না করার জন্য দুদকের আইনজীবীদের (পিপি) নির্দেশনা দেওয়া হয় কমিশনের পক্ষ থেকে। এর পর হাইকোর্ট জাহালমের বিনা অপরাধে জেল খাটার ঘটনার শুনানি করে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তির আদেশ দেন। ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে জাহালম মুক্তি পেয়েছেন। 

Bootstrap Image Preview