Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৪ শনিবার, মে ২০২৪ | ২১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

আপন মানুষ-মানবিক মানুষ

নাজমুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৪ মার্চ ২০১৯, ০৮:২৬ PM
আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯, ০৮:২৬ PM

bdmorning Image Preview


নীলফামারী, বাংলাদেশের উত্তর জনপদের একটি জেলা। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হবার কারণে বরাবরই শীতের প্রকোপ বেশি। এই জেলার ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদীর পাড় ঘেষে একটি গ্রাম খালিশা চাপালী। গ্রামটির বেপারী পাড়ায় প্রায় ৩০০টি পরিবারের বসবাস। গ্রামের সকলেই হত দরিদ্র। নগদ টাকা আয়ের সুযোগ নেই।

বছরের দুইটি মৌসুমের ফসল দিয়ে চলে তাদের জীবন। তাদের নিজেস্ব কোন জমি জমা নাই। অপরের সামান্য জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। বছরে দুইবার ধান চাষ করেন। আঞ্চলিক ভাষায় মৌসুম দুইটির একটিকে হেউদ (বোরো) এবং অন্যটি স্ক্রিম (ইরি)বলা হয়। তাদের অবস্থা খুবই করুণ। অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করে জীবন ধারণ করতে হয়। কাজের বিনিময়ে দিন প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পান। আবার টাকা কম হলেও কাজের সংকট যার ফলে ১২ মাসের মধ্যে ১১ মাসই বসে থাকতে হয়। আর এই ১১ মাসই কুমিল্লায় কৃষিকাজ ও ঢাকায় রিকশা চালিয়ে জীবন যাপন করেন।এই ভাবেই চলে তাদের জীবন।শীতের মৌসুমে হেইদ (বোরো ধান) ঘরে তুলে তারা।সেই ফসল পেয়ে ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এবারের শীতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। নতুন ফসল ঘরের গোলায় তুলে ঘুমাতে যায় বেপারী পাড়ার সকলে নিত্যকার মতই। ৯ ডিসেম্বর রাতে আগুনের লেলিহান শিখা তাদের আনন্দে বিরহের ছাপ ফেলে।আগুনে ঘর, ফসল, গবাদিপশু সব পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হয় সেই রাতে।আগুনে সব পুড়ে যাওয়ার সাথে পুড়েছে তাদের স্বপ্ন।

গত ৩০ নভেম্বর সেখানে শীতবস্ত্র বিতরণ করে এসেছি। ঘরবাড়ী গুলোর দৃশ্য এখনো চোখে ভাসছে। বেপারী পাড়া গ্রামের পূর্ব পরিচিত আব্দুর রহিম পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, ফসল আর গবাদিপশুর কিছু ছবি পাঠালেন আমাকে। ছবিগুলো দেখে ক্ষতির পরিমাণ সহজেই আন্দাজ করা গেলো। শীতবস্ত্র দেয়ার সময় তাদের দারিদ্র‍্যতা নিজের চোখে দেখেছি।রহিম পরামর্শ দিলেন, ভাই এই অসহায় লোকগুলোর জন্য কোন সহযোগিতার হাত বাড়ানো যায় কিনা আগের মত? রহিমের দেয়া ছবিগুলো সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে সকলের সহযোগিতা কামনা করি। তেমন কারো কাছে কোন সাড়া পেলাম না। ১২ ডিসেম্বর রাতে একটা ইমেইল পেলাম। বাংলাদেশের প্রথম সারির একটা সরকারি মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের সন্মানিত পরিচালক জানালেন তিনি সহযোগীতা করতে প্রস্তুত। ১৩ ডিসেম্বর সকালে হাসপাতালে রাউন্ড দেয়ার সময় ফোনকল বেজে উঠে।ফোন হাতে নিয়ে দেখি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্যার কল করেছেন। স্যার বললেন-আপনাকে আমি গতরাত থেকে ফোন করছিলাম। আপনি ই-মেইলে আমাকে আগুনে পুড়ে যাওয়া কিছু ঘরবাড়ির ছবি পাঠিয়েছেন। ছবিগুলো দেখার পর আমি ঘুমাতে পারিনি। ছবি দেখার পরপরই আপনাকে কল করি। কিন্তু আপনাকে পাইনি। নাজমুল, আমি পুড়ে যাওয়া ১২টি পরিবারকে সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু একটা শর্ত আছে। এই টাকার কথা কাউকে বলা যাবে না। কারণ তাতে রিয়া প্রকাশ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমি গোপনে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।

কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এই যুগেও এত পরোপকারী এবং নির্লোভ মানুষ আছেন! ছেলেবেলার গল্প বইয়ে হাজী মোহাম্মাদ মশসিনের কথা যেমন শুনেছিলাম, স্যারের কথায় তেমন চরিত্রের গুণাবলি। আমরা সকলেই কত সহজেই খ্যাতি পেতে চাই। স্যার কথায় কথায় নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর গুণাহগার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন। অথচ স্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। এতবড় মনের মানুষের পরিচয় একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলই নয় শুধু, তিনি একজন ডাক্তারও। বর্তমানে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্যার। প্রচারের বাইরে থাকতে পছন্দ করা এই মানুষটি আমাদের সকলের প্রিয় শ্রদ্ধেয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ স্যার।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ময়মনসিংহবাসীর সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যার জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন ৩ বছর ৪ মাস ধরে। ৫৭ বছরের মানুষটি ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন ২০ বছর। ইদানিং চোখে ছানি ধরা পড়েছে।দরকার অপারেশনের। এমন শারিরিক অবস্থায় বড্ড প্রয়োজন ছিল পরিবারের সাথে থাকা। কিন্তু হাসপাতালে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেছে নিয়েছেন সেনা অফিসার রুমের একটা রুম। যেখানে নির্বাসনের মত একা একাই বাস করছেন। একা রুমে সার্বক্ষণিক বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চিন্তা করেন। নাসির উদ্দিন স্যারের দায়িত্ব নেয়ার পর হাসপাতালে শতভাগ ওষুধ সরবরাহের দায়িত্ব নিশ্চিত করেছেন।বন্ধ করেছেন দালালদের দৌরাত্ন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চালু করেছেন দেশের প্রথম ওয়ান স্টপ সার্ভিস। পহেলা নভেম্বর ২০১৫ সালে হাসপাতালের দায়িত্ব নেয়ার পর হাসপাতালটিকে দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের জন্য রোল মডেল বানিয়েছেন। প্রসূতি সেবার জন্য  ২০১৮ সালে হাসপাতালটি দেশসেরা পুরস্কার লাভ করে। হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এনেছেন আমুল পরিবর্তন। রোগীদের জন্য তৈরিকৃত খাবারের রান্না স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য নিজেই তদারকি করেন স্যার। স্যারের এতসব পদক্ষেপ এনে দিয়েছে স্বস্তির সুবাতাস। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৬ জেলার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার বিড়ম্বনা কমিয়ে এনেছেন। মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া নাসির উদ্দিন স্যারের জন্য সইতে হয়েছে নানা বিড়ম্বনা। হাসপাতালের ওষুধ চুরি রোধ এবং দালালদের দৌরাত্ম বন্ধ করা এবং খাবার সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারদের অনিয়ম বন্ধ করার কারণে নানাবিধ হয়রানির শিকার হয়েছেন। একটি কুচক্রী মহল "ময়মনসিংহ মেডিকেলকলেজ এন্ড হাসপাতালে সাংবাদিক নিষিদ্ধ" এমন শিরোনামে একটি পুরাতন সংবাদকে স্যারের বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যবহার করে সাংবাদিকদেরকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ময়মনসিংহবাসী সবসময় এমন অপচেষ্টা রুখে দিয়েছেন। সাধারণ জনগণের ভালোবাসাই নাসির স্যারের সৎ পদক্ষেপের পথে সাহসের বাতিঘর।

গুণী মানুষদের কদর করা জানতে হয়। গুণীদের কদর না থাকলে গুণীরা জন্ম নেয় না। নাসির স্যারদের মত মানুষদের কদর করলে বাংলাদেশরই লাভ, বাংলাদেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগণের কল্যাণ।

Bootstrap Image Preview