‘আমার ছেলেগো আমি দেশে নিয়া যামু, তাগো লগে আমি শুমু। তাগো লগে শুওনের লেইগা উপরে (সৃষ্টিকর্তার কাছে) অর্ডার দিমু।’ দুই সন্তানকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বাবা মো. শাহবুল্লাহ।
রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা বাজারে ছেলেদের দোকান এস আর টেলিকম। সেখান থেকে রাত ১০ টার দিকে বাড়ি ফিরছিলেন বাবা। ফেরার আগে বাবা ছেলেদের বলেন, ‘দোকান বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসবে।’ কিন্তু দোকান থেকে অল্প দূরে যেতেই বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় দুই ছেলের।
দুর্ঘটনা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কে বি রুদ্র রোডের ১৮/২০ নম্বর বাসায় ফিরে আসা বাবা মো. শাহবুল্লাহর কান্না আর থামে না। তার এই বাসায় ফেরার স্বাদ যেন মিটে গেছে।
বাসায় আসা আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন শাহবুল্লাহকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও যেন হারিয়েছে। বাবা নিজেই ছেলে হারানোর গল্প বলে চলছিলেন সবাইকে। শাহবুল্লাহ বলেন, ‘দোকান থেকে বেরিয়ে অল্প একটু আসতেই শব্দ শুনেছি। আমি আর ওইদিকে যাইতে পারি নাই। পুরা রাস্তায় আগুন। আমার বাবারা আগুনে…।’
‘বাবা, আমার দুই ছেলে নাই। বাবা, বাবারে…। রানা, রানারে? রাজু, রাজুরে? বাবারে… (হাউমাউ করে কান্না)। বাবারে, আমার চন্দ্র-সূর্য হারাইয়া ফেলাইছি। আমার চন্দ্রও ডুবে গেছে, সূর্যও ডুবে গেছে (হাউ মাউ করে কান্না)। আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আল্লাহরে আমি অন্ধ হইলাম ক্যারে?’ অনবরত বিলাপ করে চলা মো. শাহবুল্লাহর কণ্ঠে যেন এই কথাগুলোই ঘুরে ফিরে আসছিল।
গতকাল বুধবার রাতে চকবাজারের নন্দকুমার সড়কের চুড়িহাট্টায় শাহী মসজিদের সামনে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তেই আগুন লাগে জামাল কমিউনিটি সেন্টারে। আগুনের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা ওয়াহিদ ম্যানশনে। ভবনটির প্রথম দুইতলায় প্রসাধন সামগ্রী, প্লাস্টিকের দানা ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের আরো চারটি ভবনে। রাজমনিসহ আশেপাশের কয়েকটি খাবারের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেরও বিস্ফোরণ ঘটে। পুড়ে যায় সড়কে থাকা একটি প্রাইভেটকারসহ কয়েকটি যানবাহন। এ সময় পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ আগুনের লেলিহান শিখায় মসজিদের চারপাশের ৩০০ হাত এলাকার সব বাড়ি, দোকান ও অন্যান্য স্থাপনা পুড়ে ছাই। কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়ার সাক্ষ্য দিচ্ছে সুউচ্চ ভবনগুলোও। এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু চুড়িহাট্টা জামে মসজিদ। জনমনে গভীর বিস্ময় জাগিয়ে মসজিদটি অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয়রা বলছেন, চকবাজারের নন্দকুমার দত্ত রোডের শেষ মাথায় চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওয়াহিদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আবাসিক ভবনটিতে কেমিক্যাল গোডাউন থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
অপরদিকে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৭৮ জনের মধ্যে ৪১ মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুইজন নারী, দুই শিশু ও ৩৭ জন পুরুষ।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০ হাজার করে টাকা নিহতের পরিবারের সঙ্গে দিয়ে দেওয়ার ঘোষণা এর আগেই দেওয়া হয়েছে। তবে এই টাকার খবর জানেন না মরদেহ গ্রহণকারী স্বজনদের অনেকে। টাকা নিতে আগ্রহীও নন তারা।
এ বিষয়ে স্বজন বলেন, টাকার ব্যাপারে আমাদের কোনো দাবি নেই। দ্রুত মরদেহ দিয়ে দিলেই হবে।
এদিকে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সরকারি যে নির্দেশনা দেওয়া আছে সে অনুসারেই আমরা কাজ করছি। নিয়ম বহির্ভূত কোনো কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরাও চেষ্টা করছি দ্রুত মরদেহ হস্তান্তর করতে।