"ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই। ভেজাল সারা দেশটায়, ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকি চেষ্টায়! খাঁটি জিনিস এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ভেজাল নামটা খাঁটি কেবল, আর সকলই মিথ্যে।" সাম্যবাদী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। এখন নাগরিক জীবনের অন্যতম উদ্বেগের নাম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরী ‘ভেজাল’ খাবার। মজাদার খাবার এখন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতি মুনাফা পাওয়ার লোভে লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলার শহর, হাট-বাজার গুলোতে বিভিন্ন মিষ্টি ও বেকারী ব্যবসায়ীরা মিষ্টি জাতীয় খাবারে ব্যবহার করছে মানব দেহে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ হাইড্রোজ বা ইউরিয়া। যার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। এই উপাদান গার্মেন্টস শিল্পে কাপড়ের রং সাদা করতে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে কতিপয় অর্থলোভী ব্যবসায়ীরা এই ক্ষতিকর অপাদান খাদ্য সাদা বা পরিস্কার রাখতে খাবারে ব্যবহার করছে। ফলে খাদ্য হচ্ছে বিষাক্ত।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, নিষিদ্ধ হাইড্রোজ প্রয়োগের ফলে ক্যান্সার, হাঁপানি এবং চর্মরোগ হয়। শিশু ও গর্ভবতী মায়ের জন্য এর ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক। অতি অল্প পরিমাণ ফরমালডিহাইড গ্যাস ব্যবহারও ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়ার সংক্রমণের কারণ। নিষিদ্ধ হাইড্রোজ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যা গ্রহণের ফলে মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া এই উপাদান পাকস্থলী, লিভার, কিডনী সহ জটিল রোগ সৃষ্টি করে। যে সকল খাদ্যে হাইড্রোজ হর হামেশাই দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, মুড়ি, আখ ক্ষেতের মাড়াই করা গুড়, জিলাপী তৈরীতে, মিষ্টি, মিছরি ও বেকারী সামগ্রী বিস্কুট ও কেক তৈরীতে ব্যবহার করা হচ্ছে এই ক্ষতিকর নিষিদ্ধ হাইড্রোজ।
হাইড্রোজ ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে। বয়স্ক লোকেরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মেয়েদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত দোষ-ত্রুটিসহ আশঙ্কাজনকহারে প্রতিবন্ধী, হাবাগোবা, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মুড়ি তৈরী করতে হলে ধান দুইবার সিদ্ধ করতে হয়। আর ২ বার সিদ্ধ করা ধানের চাল সাধারনত লালচে রংয়ের হয়ে থাকে। এ চাল থেকে তৈরী করা মুড়ির রং লালচে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অতি মুনাফালোভী মুড়ি ব্যবসায়ীরা মুড়িকে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মুড়িতে ব্যবহার করছে হাইড্রোজ বা ইউরিয়া। ফলে মুড়ির রং হচ্ছে ধবধবে সাদা।
আখ ক্ষেতে আখ মাড়াই করে কড়াই ভর্তি রস জ্বাল দিয়ে যে গুড় তৈরী হয় তার রং সাধারনত খানিক লালচে এবং খানিকটা কালো রং এর হয়। কিন্তু তখন এ লালচে ও কালচে গুড়কে সাদা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে হাউড্রোজ। ফলে তৈরী হচ্ছে সাদা ধবধবে আখের গুড়। মিষ্টি দ্রব্য জিলাপীর জন্য তৈরী খামির জমতে বেশ সময় লাগে। কিন্তু দোকানদাররা অল্প সময়ে জিলাপী বানাতে জিলাপীর খামিরে হাইড্রোজ মেশায়।
এতে একদিকে যেমন সময় কম লাগে অপরদিকে জিলাপীর রং হয় সাদা ধবধবে। রসগোল্লার ক্ষেত্রে করা হয় তেলে ভাজার পর হাইড্রোজ মিশ্রিত চিনির সিরায় ছেড়ে দিলে তা ধবধবে সাদা হয়। তাল মিছরি নামে সাদা ধরধবে এক ধরনের চিনির তৈরী মিষ্টি দ্রব্য দোকানে পাওয়া যায়। সেই মিছরি সাদা করতে ব্যবসার করা হয় হাইড্রোজ। আর বিভিন্ন মেলায় পাওয়া যায় এসব মিছরির তৈরী হাতী, গোড়া এবং সাদা ধবধবে কদমসহ অন্যান্য মিষ্টি সামগ্রী। এগুলো মিষ্টি খাদ্য সাদা ও পরিস্কার দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় প্রচুর পরিমানে হাইড্রোজ।
বেকারী মালিকরা হরেক করমের সাদা বিস্কুট তৈরী করতে ব্যবহার করে ক্ষতিকর হাইড্রোজ। ময়দার তেরী বিস্কুট সাদা না হওয়ায় তারা অতিমাত্রায় এই হাউড্রোজ ব্যবহার করছে। আর কেক বানানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, পচা ডিম ও এই হাইড্রোজ। তাতে করে কেক বেশ মোলাইম হওয়ায় ক্রেতারা অকৃষ্ট হচ্ছে এতে। খাদ্য দ্রব্যে হাইড্রোজ আছে তা তাৎক্ষনিক সনাক্ত করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় অসাধূ ব্যবসায়ীরা খাদ্যে নিষিদ্ধ হাইড্রোজ ব্যবহার করে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ল্যাবরেটরীতে এসব খাদ্য পরীক্ষা করলে অবশ্যই হাইড্রোজের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের স্যানেটারী ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে তদারকির না করার অভিযোগ উঠলেও এর সত্যতা স্বীকার করতে নারাজ লালমনিরহাট স্বাস্থ্য বিভাগ।
বাংলাদেশ ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালকের মতে, মানবদেহে নানা ধরণের ক্যান্সার হয়ে থাকে। যেগুলোর অধিকংশই কারণ জানা যায়নি। তবে হাইড্রোজের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক যে ক্যান্সারের বিস্তারে সক্ষম তা প্রমাণিত। এর ফলে পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি, অস্তি-মজ্জা জমে যায়।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজুমার রাইটস সোসাইটির দেয়া তথ্য মতে, ভেজাল খাদ্য খেয়ে দেশে প্রতি বছর তিন লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস ও ২ লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কার্বাইডের কারণে তীব্র মাথা ব্যাথা, ঘূর্ণি রোগ, প্রলাপ হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটা মেজাজ খিটখিটে এবং স্মরণশক্তি ক্ষতি করতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ফলে কিডনি, লিভার, ত্বক, মূত্রথলি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডাঃ কাসেম আলী জানান, আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের জন সাধারণকেও সচেতন হতে হবে। আইন দিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা সবাই জানি ওই সব খাদ্য আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর কিন্তু আমরা তা বর্জন করি না। তাই আমার মনে হয় সাধারণ জনগণ এগিয়ে আসলে ভোজাল মুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা তৈরী করা সম্ভব।