Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১২ রবিবার, মে ২০২৪ | ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মৌলভীবাজারজুড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শুরু

হৃদয় দেবনাথ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারী ২০১৯, ০৫:৪১ PM
আপডেট: ১৪ জানুয়ারী ২০১৯, ০৫:৪১ PM

bdmorning Image Preview


মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব ব্যাপক ধুমধামে শুরু হয়েছে। এ উৎসবে হিন্দু ধর্মাবলম্ভীদের প্রতি ঘরে তৈরী হয় নানান জাতের সুস্বাদু পিঠা ও খাবার। এই দিনটি উপলক্ষে প্রতিটি বাজারে বড় বড় মাছের মেলা বসে আর বাজার থেকে বড় আকারের মাছ কিনে এনে খাবার তৈরী করে আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা দীর্ঘকাল ধরেই একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাই প্রতিবারের ন্যায় পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এবারও মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পৌষ সংক্রান্তি ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শুরু হয়েছে।

সরেজমিন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর বাজারে ১৩ জানুয়ারি রাত থেকেই শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। এ মেলা চলবে তিন দিনব্যাপী।

স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীরে প্রায় দুইশ' বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে এ মেলা। তবে মাছের মেলাটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের বিভন্নি এলাকা থেকে আসা মাছ ব্যবসায়িরা বড় বড় মাছ নিয়ে ডালায় সাজিয়ে বসে রয়েছেন। মাছ কিনতে হাজারো মানুষের ভিড় নেমেছে এ মেলায়। অনেকে মাছ কিনছেন আবার অনেকেই মাছের মেলা উপভোগ করতে আসেন এই স্থানে।

স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ি মোবারক হোসেন বিডিমর্নিংকে জানান, কুশিয়ারা নদী, সুরমা নদী, মনু নদী, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুগুয়ার হাওর, কাওয়াদিঘি হাওর, হাইল হাওরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, বাঘ, আইড় মাছসহ বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন এ মেলায়। মাছ ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বৃহৎ মাছের মেলা এই কুশিয়ারার মাছের মেলা। যদিও মাছের মেলা নামে পরিচিত এই মেলা কিন্তু মাছ ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কয়েক হাজার দোকান বসে কুশিয়ারার তীরজুড়ে।

মেলায় মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থলী সামগ্রী, খেলনা সামগ্রী, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকানসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের দোকানও স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে শিশুসহ সব শ্রেণীর মানুষকে মাতিয়ে তোলার জন্য বায়োস্কোপ ও চড়কি খেলা। আগে এই মাছের মেলায় স্থানীয় বিভিন্ন হাওর-বাওরের, নদ-নদীর মাছ নিয়ে আসতো জেলেরা। স্থানীয় মৎস্য খামারগুলোর মাছ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীদের বিরাট বিরাট চালান আসে এ মেলায়। এবার এ মেলা ইজার নেওয়া হয়েছে ১৭ লক্ষ টাকায়।

সরেজমিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার মাছের মেলা পরিদর্শন:

কুলাউড়া উপজেলা:

কুলাউড়া শহরের উত্তরবাজারে বড় মাছের বাজার বসেছে। চিতল, রূই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাস, আইড়, ব্রিগেট, বাঘ মাছ, রূপ চাঁদা, ঘাস কার্পসহ বিভিন্ন জাতের মাছের সরবরাহ করেছেন ব্যবসায়ীরা। আজ শুক্রবার বিকেলে কাদিপুর ইউনিয়নের ঢুলিপাড়ায় চড়কপূজা অনুষ্টিত হবে।

জুড়ী উপজেলা:

জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের ভবানীগঞ্জ বাজারের নিউ মার্কেটের সামনে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারো মাছের মেলা বসেছে। মাছের মেলায় বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, বাউশ, কালি বাউশ, পাবদা, রুই, গাছর্কাপ, চিতল ইত্যাদি মাছ স্থান পেয়েছে।

প্রায় ১০০ জন জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী মাছ নিয়ে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। এ বারের মাছের মেলায় বোয়াল পাওয়া যাচ্ছে ১৫শ' থেকে ৩০ হাজার টাকা, রুই, ৮শ' থেকে ২০ হাজার টাকা, বাউশ ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা, আইড় ৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা, কালি বাউশ ৮শ' থেকে ৫ হাজার টাকা, চিতল ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা দরের মাছ উঠেছে মেলায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মাছ কেজিতেও পাওয়া যাচ্ছে ৩শ' টাকা থেকে ৮শ' টাকা পর্যন্ত।

এই ঐতিহ্যবাহী পৌষ সংক্রান্তি মাছের মেলায় ক্রেতা ও উৎসুক জনগণের আগ্রহের কমতি নেই। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম বেশী হাঁকাচ্ছেন বলে ক্রেতারা অভিযোগ করলেও বিক্রেতারা অবশ্য তা অস্বীকার করেছেন। তবে দু’একজন বলেছেন ক্রয় করতে মূল্য দিতে হয়েছে বেশী তাই অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার একটু বেশী। তবে উচ্চমূল্যের মাছের বাজারে বিত্তশালীদের সাথে পাল্লা দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের কেনাকাটা করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কমলগঞ্জ উপজেলা:

কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার, শমশেরনগর ও ভানুগাছ বাজারে বসেছে বিরাট মাছের মেলা। ১৪ জাুনয়ারি সকাল আটটা থেকে বিভিন্ন জাতের বড় আকারের মাছ সাজিয়ে বসেন মাছ বিক্রেতারা। পৌষ পার্বন উপলক্ষে ঘরে উঠা নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরী নানা ধরনের মিষ্টি পিঠা পুলির সাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে রাখা হবে চিনি ও গুড়ের তৈরী বাতাসা, জিলাপি, গুড় ও তিলের মিশ্রণে তিলের চাটা ইত্যাদি। তার চেয়ে বড় আকর্ষণ থাকে বাজার থেকে পছন্দ মত বড় আকারের মাছ কিনে খাবার তৈরী করা।

শমশেরনগর বাজারে মাছের মেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মাছের দোকানে সামান্য ছোট আকারের মাছ সাজিয়ে রাখা হলেও সংগ্রহে রাখা হয়েছে নানা জাতের বড় আকারের মাছ। চিতল, রূই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাস, আইড়, ব্রিগেট, বাঘ মাছ, রূপ চাঁদা, ঘাস কার্পসহ নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ। কিছু কিছু দুর্লব মাছ যে গুরো সহজে হাট বাজারে পাওয়া যায় না এমন মাছও সাজিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। বিক্রতারাও বেশ চড়া দাম হাকালেও শেষ পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ের দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে।

মুন্সীবাজারে মাছের মেলায় দেখা যায়, সামনের দিকে পান পাতার মত ক্রমান্নয়ে পিছনের দিক সরু হয়ে ছোট লেজে মিশে গেছে এমন একটি দুর্লব সামুদ্রীক মাছে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাছ বিক্রেতা জানান, এটির নাম পান পাতা মাছ। মাছটির কোন দাম না বলে তিনি জানান শুধু মাত্র মডেল হিসাবে এ মাছটি দোকানে রাখা হয়। ১৭ কেজি ওজনের একটি বাঘ মাছের দাম নির্ধারণ করেন বিক্রেতা ২৫ হাজার টাকা। ১০ কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছের দাম ছিল ১৫ হাজার টাকা। ১০ কেজি ওজনের একইট রুই মাছের দাম ছিল ১৩ হাজার টাকা। ক্রেতা সঞ্জয় দাম গুপ্ত, সুজিত দেব নাথ ও সমরজিৎ বর্মা জানান, এ উৎসবে বাজারে নানা জাতের বড় আকারের মাছ উঠে। এটি দেখারও একটি বিষয় থাকে। দাম বেশী হলেও পরে দরাদরি করে কিনে নিতে হয়।

মাছ বিক্রতা মানিক মিয়া, মারুফুর রহমান মুকুল, আমির হোসেন বলেন, দাম বড় কথা নয়। মূলত ক্রেতাদের আকর্ষিত করে এমন বড় আকারের মাছ সরবরাহ করা হয় মাছ মেলায়। যদিও বেশ চড়া দাম বলা হলেও ক্রেতারা দরাদরি করে পড়ে সহনীয় পর্যায়ে হলে কিনে নিচ্ছেন। আর পরিবহন ব্যয় ধরে সামান্য লাভ হাতে রেখেই অবশেষে দাম কমিয়ে মাছ বিক্রি করছেন তারা।

মাছের আড়ৎদার আব্দুল মিয়া বলেন, আগের চেয়ে এখন দেশীয় মাছের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। সাধারণত বাজারে এত বড় আকারের মাছ উঠে না। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাওর, বাওর, বিল ও বড় নদী থেকে ধরে আনা বড় আকারের মাছ এ বিশেষ দিনের জন্য সরবরাহ করতে হয়। তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তারা বাজারের নানা জাতের বড় আকারের মাছ সরবরাহ করেছেন।মাছ মেলায় বৃহস্পতিবার গভীর রাত এমনকি শুক্রবার পর্যন্ত এ বিক্রয় চলবে বলে আড়ৎদার জানান।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা:

শ্রীমঙ্গলে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় উঠেছে আড়াই মণ ওজনের বাঘাড়, যার দাম হাঁকা হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাওড়-নদী থেকে ধরে আনা দেশীয় প্রজাতির এই বড় বড় মাছ সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন এসব মেলায়।

মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইল হাওর এবং কুশিয়ারা নদীসহ সিলেটের বিভিন্ন হাওর বাওরের মাছ নিয়ে বসেছে তিন দিন ব্যাপী এ মেলা। মাছ ছাড়াও মেলায় উঠেছে মাছ কাটা এবং ধরার সামগ্রীও।

এ মেলায় ওঠা আড়াই মণ ওজনের বাঘাড় মাছ দেখতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সবাই। যেটি কুশিয়ারা নদীর এক জেলের কাছ থেকে কিনে মেলায় নিয়ে এসেছেন শ্রীমঙ্গল লালবাগের মাছ ব্যবসায়ী আলফু মিয়া। তিনি বলেন, মাছটি ডিসপ্লে করার পর থেকে ক্রেতার চেয়ে উৎসুক জনতার ভিড়ই হচ্ছে বেশি। উপযুক্ত দামের ক্রেতা না পেলে পড়ে কিছুটা কমেও বিক্রি করবো।

আরেক মাছ ব্যবসায়ী মফিজ বলেন, মেলায় তিনি ৩৫ কেজি ওজনের বোয়াল, ২২ কেজি ওজনের চিতল, ১৯ কেজি ওজনের কাতল এনেছেন। এর মধ্যে ৩৫ কেজি ওজনের বোয়ালের দাম ৭৫ হাজার টাকা, চিতলের দাম ৪০ হাজার টাকা হাঁকছেন তিনি। প্রায় সম পরিমাণ দামে ইতোমধ্যে বেশ কিছু মাছ বিক্রি করেছেন বলে তিনি জানান।

মেলায় বাঘাড় মাছ ছাড়াও ২০ কেজির উপরে উঠেছে রুই, কাতল, চিতল, বোয়াল ও আইড় মাছ। এ ছাড়াও মেলায় উঠেছে আরও প্রায় অর্ধশত প্রজাতির তাজা মাছ। মাছ কিনতে নয় দেখার জন্যও অনেকে এসেছেন মেলায়। বড় বড় মাছ দেখাতে অনেকে শিশু কিশোরদেরও নিয়ে এসেছেন।

মেলায় আসা শ্রীমঙ্গল সদর ইউপি চেয়ারম্যান ভানুলাল রায় বলেন, বিশাল বাঘাইড় মাছ উঠেছে শুনে মেলায় এসেছি। এর আগে এতো বড় মাছ মেলায় উঠেছে বলে শুনিনি।

মেলার দর্শনার্থীরা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে এ জাতীয় মেলার আয়োজন করলে মাছের সঠিক প্রজনন ও বিলুপ্ত প্রজাতি সংরক্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ এই মেলার জন্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে বৃহৎ আকৃতির মাছ উৎপাদন করবে মাছ চাষিরা। মেলায় বৃহৎ মাছ আমাদানিকারক ও উৎপাদনকারীর জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন বলেও জানান তারা।

Bootstrap Image Preview