একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ের পর গতকাল মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নতুন ২৭ জন। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার পরিচালনায় মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের সামনে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে এনার্জি, ট্রাডিশন, টেকনোলজি আর নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ফাইন ব্যালান্স করে আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। নতুন মন্ত্রীরা যখন কাজে মনোনিবেশ করবেন, তাদের দায়িত্ব পালনের মধ্যে নির্ভর করবে সাফল্য-ব্যর্থতা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে নতুন দায়িত্ব পেলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে এতদিন দায়িত্বে ছিলেন। দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনা, ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ কু-ঋণ রয়েছে তা উদ্ধার করতে হবে। শেয়ারবাজারে রয়েছে আস্থার সংকট। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের চেয়েও নাজুক বীমা খাত। বীমা শিল্পের প্রতি গ্রাহকের আস্থা খুবই কম। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে গতকাল শপথ নিলেন টিপু মুনশি। এ মন্ত্রণালয়ের বড় চ্যালেঞ্জ রপ্তানি বৃদ্ধি। বিশেষ করে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে আনা। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করারও চ্যালেঞ্জ থাকবে তার সামনে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে যেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে দেশ সে বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণ করতেও পদক্ষেপ নিতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন সাধনচন্দ্র মজুমদার। এই মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই হবে নতুন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। সদ্য বিদায়ী সরকারে থেকে যারা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে পরিচালিত করেছেন, তাদের সরকারি খাদ্যক্রয়, মজুদ, সংরক্ষণ ও বিপণনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিপাকে পড়তে হয়েছে। চালের দাম গিয়েছে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। খাদ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে জনমনে অসন্তোষ ছিল।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি খাতে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগোতে হবে নতুন সরকারকে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এমন দাবি সরকারের থাকলেও বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে এবারও চাল আমদানি করতে হয়েছে। নতুন সরকারকে খাদ্যে সম্পূর্ণতার বিষয় নিয়ে জনমনে জমে থাকা বিভ্রান্তি অবশ্যই দূর করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক নিজেও একজন কৃষিবিদ। সে হিসেবে মন্ত্রণালয়ের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা তার জন্য সহজ হবে বলে আশা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষা খাতে গত দশ বছরের অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে নতুন শিক্ষামন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ। শিক্ষা খাতে ক্যানসারখ্যাত পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ছিল সরকারের জন্য বিব্রতকর। আরও চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া। মন্ত্রণালয়াধীন অধিদপ্তর, বোর্ড, দপ্তরগুলোয় সিন্ডিকেটমুক্ত করা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা। সর্বোপরি শিক্ষা প্রশাসনে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা হবে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন একেএম শাহজাহান কামাল। এ দপ্তরের জন্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে গতকাল শপথ নিয়েছেন মাহবুব আলী। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে লোকসানি খাত থেকে রক্ষা করা জরুরি। এ ছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দরের মান ক্যাটাগরি-২ থেকে ১-এ উন্নীত হওয়া ছাড়া পথ নেই। নতুন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মাহবুব আলীর বড় দায়িত্ব হবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় জোর দেওয়া। তা ছাড়া ঝুলে থাকা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণকাজও এবার সামনে চলে আসতে পারে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট এবং বন্দরগুলোর ব্যবহার বড় চ্যালেঞ্জ। ট্রানশিপমেন্টের এসব বিষয় পরিকল্পিত ও সচেতনভাবে এগিয়ে নেওয়াই হবে তার বড় কাজ।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। দুজনই মন্ত্রিসভার নতুন সদস্য। এ মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ হবে আন্তর্জাতিক নদীগুলো থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং নদী খনন করে অভ্যন্তরীণ নদীরগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা। ভাঙন প্রতিরোধের মাধ্যমে নদীশাসন, লবণাক্ততা-জলাবদ্ধতা নিরসন করে খাদ্য নিরাপত্তা ও পানি শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন। বর্তমানে রেলওয়ের কয়েকটি মেগাপ্রকল্প চলমান। এর মধ্যে পদ্মা রেল সংযোগ, কক্সবাজার-দোহাজারি রেলপথের মতো অগ্রাধিকার প্রকল্প রয়েছে। সময়মতো এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা রক্ষা, ইঞ্জিন-কোচের সংকট দূর করা বড় কাজ।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে বিদায় করে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকে। তিনি প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন। একই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হলেন কামাল আহমেদ মজুমদার। শিল্প মন্ত্রণালয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষ করে শিল্পপার্কগুলোয় নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যবসায়ীদের জন্য বিসিকের বরাদ্দকৃত প্লটগুলোয় জ্বালানির সংযোগ দেওয়া ও প্লটের ব্যবস্থাপনা, চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতিতে জাহাজভাঙা শিল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।