অগ্নিঝরা ১৯৭১ সালের এই দিনে নিজেদের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। তবুও পাক হানাদার বাহিনির সাথে হাত মেলাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। চাইলেই নিজের স্বার্থে সমস্ত ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পারতেন। কিংবা পারতেন অন্য দেশে চলে যেতে। তেমন প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয় মাতৃভূমি ও বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাননি দেশের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ও দেশপ্রেমের করণে। নিজের যথাসার্ধ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। যার করুণ পরিণতি হিসেবে বরণ করতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন এবং মৃত্যু।
বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শহীদ বুদ্ধিজীবী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, হবিবুর রহমান এবং মীর আব্দুল কাইয়ুমের কথা। কোনো দেশকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের লাইব্রেরি কিংবা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে হবে। দেশকে যাতে নেতৃত্ব দিয়ে দেশেকে স্বাধীন করতে না পারে এজন্য স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য পাকিস্তানিরা এসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার নীল নকশা প্রণয়ণ করে। তাদের সেই তালিকায় ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীরা।
অথচ বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেধাবী’ অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না তাদের অবদান সম্পর্কে এমনকি নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত এসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাস। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু কয়েকটি ভবনের নামকরণ করা হলেও তাদের ইতিহাস জানার অন্য কোন উপায় নেই। বিভাগগুলোতে হয়না কোন আলোচনা সভা। এই বুদ্ধিজীবীদের উপর তেমন বইও নেই। তাই আপন বিভাগেই পর এসব বুদ্ধিজীবীরা।
শহীদ হবিবুর রহমান
শহীদ হবিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি গণিত বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী হবিবুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। যুদ্ধের সময় তাকে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা বলা হলেও তিনি বলেছিলেন, ‘জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো আমি শেষ ব্যক্তি হিসেবে এই স্থান ত্যাগ করবো।’ বাংলাদেশ সরকার তার অবদানকে স্বীকৃতি দিতে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, যুদ্ধের সময় ইপিআর বাহিনীর (মুক্তি বাহিনী) একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলো প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে। তাঁদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন শহীদ হবিবুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতার কারণে ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। ধারণা করা হয় সেদিনই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত গণিত বিভাগ। অথচ বিভাগের শিক্ষর্থীরা জানেন হবিবুর রহমান তাদের বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছেন। তার সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস জানেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত পাঁচ বছরে হয় নি কোন হবিবুর রহমান স্মরণে আলোচনা সভা, অনুষ্ঠান কিংবা দোয়া মাহফিল।
শহীদ হবিবুর রহমানের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের একটি আবাসিক হলও রয়েছে। তার উপর লেখা একটি স্মারক বই রয়েছে।এই হলে হবিবুর রহমানের ইতিহাস নিয়ে শুধুমাত্র একটি বই রয়েছে। সেটাও পড়েননি হলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা।
হলের সামনে হবিবুর রহমানের আবক্ষ মূর্তিসহ ‘বিদ্যার্ঘ’ নামে একটি ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্যটি কার স্মরণে বানানো হয়েছে জানলেও আবাসিক শিক্ষার্থীরা এই ভাস্কর্যের মর্মার্থ জানেন না।
শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগেরই ছাত্র ছিলেন। এরপর ১৯৬৬ সালে মনোবিজ্ঞান বিভাগের ডেমন্সট্রেটর এবং পরে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ুম। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। তার অপরাধ ছিলো তিনি মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে অনেকের সাথেই জীবন্ত কবর দেয়া হয়। রাজশাহীর পদ্মা তীরবর্তী বাবলাতলার বধ্যভূমিতে তাকে কবর দেয়া হয়েছিলো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। পরবর্তীতে নগরীর হেতেম খাঁ কবরস্থানে তাকে পুনঃসমাহিত করা হয়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সাথে গণঅভ্যুত্থানেও অংশগ্রহন করেন মীর আব্দুল কাইয়ুম।
এই বিভাগেরই বর্তমান অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূমের কন্যা। তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একদিন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা করলেই শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা হয় না। অন্তরে ধারণ করতে হয়। এছাড়াও এ বিভাগের শিক্ষক হিসেবেও তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। তবে পুরো পরিবার তাকে হারানোর যে কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে তা অপূরণীয়। এই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যারা গেছে শুধু তারাই বলতে পারবে। সন্তান হিসেবে চাই অপরাধীকে অপরাধী বলা হোক। রাজাকারকে রাজাকার বলা হোক। যেসব শিক্ষক ওইসময় পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছিলো সেইসব রাজাকার শিক্ষকদের কোন তালিকা নেই। এগুলো খুবই কষ্টের।’
শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার
অন্য দুজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নামকরণ বেশ আগেই হলেও শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের ক্ষেত্রে ‘স্বীকৃতি’ পেতে লেগেছে ৪৩ বছর। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সাংষ্কৃতিক কেন্দ্রের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের নামে। নিজ বিভাগে তিনি যেন আরো বেশি পরবাসী।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ১৯৫৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে যোগ দেন। ভাষা বিভাগের অন্তর্ভূক্ত সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার অধিকারী এবং নজরুল ও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিলো। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল যুদ্ধে আহত এক ইপিআর সৈন্যকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেন। বিপদ হতে পারে জেনেও সেই আহত যোদ্ধার ক্ষতস্থান নিজে বেঁধে দেন এবং সারা রাত তার সেবা করেন। পরদিন ১৪ এপ্রিল সকালে ইপিআর যোদ্ধা চলে গেলে তার নিজ বাসভবন থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঘাতকরা সেদিনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। তাঁর বাসার গোয়ালা গুলিবিদ্ধ সুখরঞ্জনকে মাটিচাপা দেন। যা বিজয়ের পর তিনি পরিবারকে জানান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে তার লাশ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্ত্বরে পুনঃসমাহিত করে।
শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের কবর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্ত্বরে অবস্থিত এটিও অনেকে জানেন না। অন্য দুটি বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরির নামকরণ শহীদদের নামে হলেও ভাষা বিভাগের কোন কিছুর নামরকরণই করা হয়নি এই শহীদ বুদ্ধিজীবির নামে। বিভাগেও নেই তার ইতিহাস বা জীবিনী সংক্রান্ত কোন বই। ফলে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন ইতিহাস জানা থেকে।
’তরুণ প্রজন্মের এই ইতিহাস না জানার পেছনে শিক্ষক-ছাত্র উভয়কেই দায়ী করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ‘আমি যখন হবিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলাম তখন হলে একটি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছিলাম। তখন গণিত বিভাগের একজন শিক্ষককে বক্তব্য দেবার আমন্ত্রন জানাতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘এসব করে কি হবে?’ নিজ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই বুদ্ধিজীবীদের ধারণ করতে শেখেনি। আর এখনকার শিক্ষার্থীরা ইতিহাস জানার চেয়ে বিসিএস নিয়ে বেশি ব্যস্ত।’
তিনি আরো বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী দিবস, মুক্তিযুদ্ধ এগুলোকে এখন রাজনৈতিক বিষয় বানানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো ঐতিহাসিক বিষয়, রাজনৈতিক কিছু নয়। এসব নিয়ে আলোচনা হলেই রাজাকার, পাকিস্তানি, ঘাতকদের কথা আসবে সেগুলো কিছু শিক্ষকদের সহ্য হবে না। তাই আলোচনা সভা, সেমিনার বা ইতিহাস জানানোর ব্যবস্থা করা হয় না।’