রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন মীর আবদুল কাইয়ূম। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি গোপনে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ সরবরাহ করাসহ অর্থের যোগান দিতেও সাহায্য করতেন।
তাঁর পরিবার সূত্রে জানা যায়- ‘যখন ৭১-এ অনেকেই দেশ ছেড়ে ওপারে চলে গেলেন তখনো কাইয়ূমের কণ্ঠে একই কথা “দেশ ছেড়ে যাব না, দেশে থেকে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবব, দেশ একদিন স্বাধীন হবেই, কিন্তু দেখে যেতে পারব তো?” তাঁর এই সংশয়ই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো, স্বাধীনতা আর তাঁর দেখে যাওয়া হলো না।’
তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন পাকিস্তানি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনেও ছিল অনেক অবাঙালি। তারা কেউ কেউ ছিল সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার কারণে মীর আবদুল কাইয়ূম তাদের বিশেষত তাঁর বিভাগের পাকিস্তানি শিক্ষকদের নজরে পড়ে যান।
২৫ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিভাগের অবাঙালি কর্মচারী তৈয়ব আলী মীর আবদুল কাইয়ূমের কাছে এসে জানান, এক ক্যাপ্টেন তাঁকে জোহা হলে যেতে বলেছে। সেনারা তখন অদূরে রাস্তার আড়ালে ছিল।
একাত্তরের এপ্রিলে মীর আবদুল কাইয়ূমের মালোপাড়ার বাসা খান সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণে তিনি ঘোড়ামারায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মালোপাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষক থাকতেন। ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত শিক্ষক কোয়ার্টার না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের জন্য ওই বাসাগুলো ভাড়া নিয়েছিল।
প্রথমে তিনি যেতে চাননি। ১৯৭১ সালে ২৫ নভেম্বর রাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্টেনো গ্রাফার দুই মিনিটের জন্য বাইরে ডেকে নিয়ে যায় এবং সে রাতেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ৩০শে ডিসেম্বর তার ডেড বডি পাওয়া যায় বোয়ালিয়া পদ্মার চরে। একসাথে ১৪ জনকে জীবন্ত পুতে হত্যা করা হয়।
যে ব্যক্তি তাকে ডেকে নিয়ে যায় সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের স্ট্যানো গ্রাফারের কাজ করতেন। তার নাম ছিল তৈয়ব আলী। বিজয় দিবসে মাত্র কয়েকদিন আগে ২৫ নভেম্বর। যখন পুরো দেশসহ রাজশাহী মুক্তি হয়ে গেছে এরকম সময়ে একটা নকশা প্রণয়ন করা হয়। আমার বাবা সেই লিস্টে ছিলেন। আর সেই নীল-নকশা অনুযায়ী তাকে কৌশলে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন অফিসার ডাকছে বলে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। রাত তখন আটটা কিংবা সাড়ে আটটা বাজে। সেই রাতে তিনি একটি শার্ট পড়ে চলে যান। সেদিন তার শরীরটা একটু খারাপ ছিল। মানে একটু জ্বর জ্বর ছিল। এবং তিনি আসছি বলে আইডি কার্ড নিয়ে বের হয়ে যান। আইডি কার্ডটি নিয়ে বের হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী পিছন পিছন গিয়ে দেখলেন একটা সাদা জিব গাড়ি তুলে নিয়ে গেলো।
তারপর বহু খোঁজাখুজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেদিন রাতেই রাজশাহীর ১২ থেকে ১৪ জনকে একসাথে তুলে নিয়ে গিয়ে বোয়ালিয়া পদ্মার চরে (বোয়ালিয়া ক্লাব বলে একটা অফিসার্স ক্লাব আছে) ক্লাবের কাছেই শ্রীরামপুর নামের একটা জায়গায়। পদ্মা নদীর তীরে বালুর চরে সেই ১৪ জনকে জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের প্রত্যেকের হাত পিছন থেকে দড়ি দিয়ে বাঁঁধা ছিল। তাদের গায়ে কোনো বুলেটের চিহ্ন ছিলো না। এরপর অনেক খোঁজাখুজির পর ৩০ নভেম্বর পদ্মার চরে একজন লোক গিয়ে দেখে একটা হাত দেখা যাচ্ছে। পরে সেই বালুর মধ্যে এক সাথে চৌদ্দ জনের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। বালুর মধ্যে লাশগুলোর চেহারা বিকৃত হয় নি বলে সনাক্ত করতে সহজ হয়েছে। এরপর ওখানে থেকে উদ্ধার করে বাবাকে কাদিরগঞ্জ গোরস্থানে দাফন করা হয়।
মীর আবদুল কাইয়ূমের জন্ম ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ঘাগড়া গ্রামের মীরবাড়িতে, ১৯৩৯ সালের ৬ জুলাই। বাবা মীর সুবেদ আলী মা জাহানারা বেগম। ছোটবেলায় তিনি বাবাকে হারান। গফরগাঁও কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাঁকে খুব পছন্দ করত।
তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। মৃত্যুর সময় ছোট সন্তান তাঁর স্ত্রীর গর্ভে ছিল। স্বাধীনতার পর তাঁর জন্ম। বড় ছেলে টেলিকম ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। বড় মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ছোট মেয়ে প্রবাসী।