যশোর-২ আসনের বিএনপি প্রার্থী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাবিরা সুলতানা মুন্নীর দণ্ড ও সাজা স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। তিন বছরের কারাদণ্ড পাওয়া এই বিএনপি নেত্রী উচ্চ আদালতে আবেদন করে তার দণ্ড স্থগিত করতে পেরেছেন। আর এর ফলে তার ভোটে আসার পথ উন্মুক্ত হলো।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে বিএনপির মনোনয়নের চিঠি পাওয়া সাবিরা সুলতানা দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের সাজা পেয়েছেন গত ১২ জুলাই। সেই সঙ্গে এক কোটি ৭৮ হাজার ১৩৫ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের আদেশও এসেছে।
একই সঙ্গে আদালত বলেছেন, আপিল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড বা সাজা (সেন্টেন্স অ্যান্ড কনভিকশন) চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে না। নিম্ন আদালতের দেয়া দণ্ড ও সাজা স্থগিতের ক্ষমতা হাইকোর্টের রয়েছে।
তারা আশা করছে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করিয়ে ভোটে আনা যাবে।
খালেদা জিয়া আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিষয়টির আইনগত দিক আমরা দেখছি। দেখি নির্বাচন কমিশন ম্যাডামের মনোনয়নের বিষয়ে কী করে। তারপর আমরা পদক্ষেপ নেব।’
এই রায়ের পর ১৭ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলামের আদালতে আত্মসমর্পণ করে আপিলের শর্তে জামিনের আবেদন করেন। আদালত আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠালে তিনি গত ৬ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর সাবিরা বৃহস্পতিবার আসেন হাইকোর্টে। আবেদন করেন দণ্ড স্থগিতের। তার পক্ষে শুনানি করেন আমিনুল ইসলাম। মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন এ বি এম বায়েজিদ।
বিচারপতি মোহাম্মদ রইচ উদ্দিনের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দেয়। এতে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তির দণ্ড আপিল বিভাগে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার সাজা বা দণ্ড চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে না। তবে আপিল চলাকালে তার সাজা বা দণ্ড স্থগিত হলে তিনি নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হবেন না।’
বিচারিক আদালতের দণ্ডিত ব্যক্তির সাজা কিংবা দণ্ড স্থগিত করার ক্ষমতা হাইকোর্ট বিভাগের রয়েছে বলেও পর্যবেক্ষণে বলা হয়।
সাবিরার আইনজীবী আমিনুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাবিরা সুলতানার দণ্ড স্থগিত চেয়ে আবেদন জানালে আপিল বিভাগ তা নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের একক বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। শুনানি নিয়ে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬ (১) ধারা এবং সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে সাজা ও দণ্ড স্থগিত করে আদেশ দেন। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে তার আর কোনো বাধা থাকল না।’
‘এই আদেশের পর থেকে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান তারা হাইকোর্টে সাজা বা দণ্ড স্থগিত চেয়ে আবেদন করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।’
‘তবে আদালত যাদের দণ্ড স্থগিত করেনি তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে আজকের এই আদেশের পর যারা এই আদেশের আলোকে হাইকোর্টে দণ্ড স্থগিত চেয়ে আবেদন করবেন এবং যদি আবেদন গ্রহণ করা হয় তবেই তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।’
রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা জানান, তারা এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবেন। সেখানে দণ্ড স্থগিত হলেই কেবল নির্বাচনের পথ খুলবে সাবিরার।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ একই রকম মামলার আদেশে বলেছিলেন, নির্বাচনের উদ্দেশে কেউ দণ্ড বা সাজা স্থগিত করার পর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এরপর সেই আদেশের বিরুদ্ধে এক বিএনপি পন্থী নেতা আপিল করেন। পরে সেই আবেদনে আপিল বিভাগ থেকে কোনো আদেশ দেননি। ফলে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ বাহালই রইলো আপিল বিভাগে।’
তিনি বলেন, এর একদিন পর বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ বললেন, দণ্ডিত ব্যক্তির সাজা হাইকোর্টে স্থগিত হলে দণ্ডিতরা নির্বাচন করতে পারবেন। তাহলে তো এটা পূর্বের আরেকটি হাইকোর্ট বেঞ্চের বিপরীতধর্মী আদেশ হলো। ফলে হাইকোর্টের আজকের আদেশটি সংবিধান পরিপন্থী। তাই এ আদেশের বিরুদ্ধে আমরা আপিলে যাব।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আরো বলেন, যে কোনো বিচারক তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু সবার উপরে আমাদের সংবিধান। আমাদের বিচারকরা বিচার করেন সাংবিধানিক বিধি মেনে নিয়ে। আমাদের সংবিধানের স্পষ্ট আছে দুই বছরের অধিক সাজাপ্রাপ্ত হলে এবং নৈতিক স্খলনজনিত কারণে এই সাজা হলে ওই ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবে না। আর ইতোমধ্যে তিনি যদি মুক্তি লাভও করেন তবুও তাকে ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। কাজেই এই আইনের পরিপন্থী যদি কোনো আদেশ হয়, অবশ্যই আমরা বিষয়টি আপিল বিভাগের দৃষ্টিতে আনব।
এর আগে বিএনপি পাঁচ নেতা তাদের দণ্ড স্থগিত করতে হাইকোর্টে আবেদন করে তাদের পক্ষ আদেশ আনতে ব্যর্থ হন। পরে আপিল বিভাগে যান তারা। সেখানেও ‘নো অর্ডার’ দেয়া হয়।
এই আদেশের ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির অন্তত ১৮ জন নেতার ভোটে অংশগ্রহণের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
কারণ, সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কারও দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি ভোটে আসনে পারবেন না। খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্ট থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের রায় এসেছে। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতে সাজা হয়েছে সাত বছর।
এর মধ্যে অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল হয়েছে হাইকোর্টে। আর অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশ না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ আপিল করা যায়নি। বিএনপি নেত্রীর আইনজীবীরা চেম্বার জজ আদালতে সিএমপি (সাময়িক আপিল) আবেদন করেছেন।
এই দুটি আবেদনের একটিরও শুনানি হয়নি। শুনানির তারিখও পড়েনি। আর ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসনে যে মনোনয়নপত্র বিএনপি নেত্রীর নামে জমা পড়েছে, সেটি যাচাই বাছাই হবে ২ ডিসেম্বর। কিন্তু এর আগে শুনানি হবে কি না, এটি নিশ্চিত নয়।
দণ্ড স্থগিত করাতে বিএনপির হাতে আছে আর একটি মাত্র দিন। কারণ ৩০ নভেম্বর এবং ১ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ছুটিতে বসবে না আদালত। আর এরপরদিনই মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই করে তা গ্রহণ করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন রিটানির্ং কর্মকর্তা।
অবশ্য রিটানির্ং কর্মকর্তার এই আদেশের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে আপিল করা যাবে। আর সেখানেও সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। এই প্রক্রিয়ায় একাধিক নেতা নানা সময় ভোটে এসেছেন।