নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে ফেসবুকে আপত্তিকর ম্যাসেজ প্রদান করে ফেঁসে গেলেন নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) গোলামুর রহমান। ফেসবুকে নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে একান্তে কাছে পেতে লিখেছিলেন 'ইউ আর মাই টপ কনফিডেনসিয়াল অফিসার' সহ নানা রকম ভাবপূর্ণ কথা। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করলে ও এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর বদলী হলেন ডিসি।
গতকাল সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে তার বদলীর আদেশ জারী করা হয়। জানা যায় তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মো. শাহরিয়াজ (৬৬৯৪)।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন গোলামুর রহমান। বিসিএসএসের ২০তম ব্যাচের এই ক্যাডার অফিসার সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন। শিপিং কর্পোরেশনের ম্যানেজার হিসেবে। সম্প্রতি পদন্নতি পেয়ে ২০তম জেলা প্রশাসক হিসেবে তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। তবে যোগদানের পর থেকেই সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতা এবং নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরন এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে ক্ষুদ্ধ নাগরিক সমাজ।
জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান যোগদান করার পর তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠে তার কার্যালয়ের নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌন হয়রানির বিষয়টি।
পরে ভুক্তভোগি ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিত ভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবগত করলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তবে মান সম্মানের ভয়ে ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। শুধু নারী ম্যাজিস্ট্রেট নয় জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে বগুড়া আর্ট কলেজের এক ছাত্রীকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে অাপত্তিকর প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
গত ৭ নভেম্বর নাটোর শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে পুরাতন ডিসি বাংলো পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান। এসময় ডিসি বাংলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ডিসি অফিসের মাস্টার রোলের কর্মচারী মোতালেব হোসেন গেটের চাবী আনতে দেরি করায় শারীরিক ভাবে তাকে মারপিট করেন ডিসি। এছাড়া কর্মচারী মোতালেব সহ দুজনকে চাকরিচ্যুত করে বাংলো থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন ডিসি। এ নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এবিষয়ে মাষ্টার রোলের কর্মচারী মোতালেব হোসেন কান্নাজড়িক কণ্ঠে বলেন, আমার ভুলের কারণে ডিসি স্যার আমাকে মেরেছে।, বিষয়টি সমস্যা নাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, আমার ত্রিশ বছর চাকরির জীবনে এত খারাপ ডিসি আগে কখনও দেখিনি। সে যোগদানের পর থেকে পুরো ডিসি অফিসে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। তার ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়না।
যোগদানের পর থেকেই সরকারী দপ্তরের বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতা এবং নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরন এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে ক্ষুদ্ধ নাগরিক সমাজ।
এবিষয়ে নাটোর সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ শহিদল্লাহ বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসকের কোন সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না। সালফার আনার অনুমতির জন্য ১৫দিন ধরে তার কার্য্যালয়ে ঘুরাঘুরি করে সে অনুমতি দেয়নি। মিলটি যেকোন দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া মিল জোন এলাকায় পাওয়ার ক্রাসার দিয়ে অবৈধ ভাবে আখ মাড়াই চললেও জেলা প্রশাসকের কোন সহযোগিতা পায়নি। যার কারণে এবারও মিলটি লোকসান গুনতে পারে।
এছাড়া গত ৭নভেম্বর কান্দিভিটা এলাকার ঐতিহ্যবাহি পুরাতন পার্ক ভেঙ্গে লেডিস ক্লাব করে বর্তমান জেলা প্রশাসক। স্বারকলিপি দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এ নিয়ে স্থানীয় সুশীল সমাজের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি নাটোর জেলা শাখার সভাপতি রনেন রায় বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসক যোগদানের পর থেকে প্রশাসনে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। একজন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে যৌনহয়রানি, কর্মচারীকে মারপিট এমন সব গুরুতর অভিযোগ মেনে নেওয়া যায়না। যে নাটোরবাসীকে নিরাপত্তা দিবে, সে কিনা নিজেই অপরাধ করে বসছে। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।
অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান বলেন, কখনও কখনও তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হয়। কেউ হ্যাক করে এই কাজগুলো করে থাকতে পারে।
ফেসবুক আইডি হ্যাক হলেও আপনি আইনগত ব্যবস্থা নেননি কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলে। তবে আমি ফেসবুকের বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে চাইনা। তবে কোন কর্মচারীকে মারপিটের ঘটনা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে, নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌনহয়রানি, কর্মচারীকে মারপিট এবং সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতা সহ ৬দফার একটি গোপন প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোপন ওই প্রতিবেদনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বিরোধ উল্লেখ করে আসন্ন নির্বাচনে সমস্যা তৈরী হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই ধরনের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন নাটোরের সচেতন মানুষ।
এবিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে ভুক্তভোগি প্রতিকার চাইলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।