Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১২ রবিবার, মে ২০২৪ | ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নাইকো দুর্নীতির ঘুষের টাকা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নিয়েছেন: এফবিআই

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২২ PM
আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২২ PM

bdmorning Image Preview


কানাডার রয়্যাল মাউন্টেড পুলিশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) কর্তৃক খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা নাইকো দুর্নীতি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এক সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলায় কানাডার পুলিশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সাক্ষ্য নিতে বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়েছে। দুই দেশের তিন তদন্ত কর্মকর্তার জবানিতে নাইকো দুর্নীতিতে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার কথা এসেছে।

তিনি জানান- এ প্রসঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা (এফবিআই-এর কর্মকর্তা) ডেবরা গ্রিফিত তার দেওয়া সাক্ষ্যে জানিয়েছেন, তার তদন্তে উঠে এসেছে কাশেম শরিফ নিয়ন্ত্রিত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গিয়েছে সেলিম ভুঁইয়া, বাবুল গাজী ও জামাল শামসির কাছে। প্রমাণ রয়েছে এসব অর্থ ছিল ঘুষের অর্থ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ অন্যদের দেওয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের হাতে দেওয়া হয়েছে এই অর্থ।

তিনি বলেন, কানাডাতে নিবন্ধিত নাইকো আমাদের দেশের কয়কটি গ্যাসফিল্ড লিজ নেওয়ার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। ২০০২ সাল পর্যন্ত পূর্ব ছাতক গ্যাসফিল্ডটি একটি ভার্জিন গ্যাসফিল্ড (গ্যাসে পরিপূর্ণ) ছিল বলে বাপেক্স এবং আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলা অভিমত প্রদান করে আসছিল। কিন্তু নাইকো নানারকম অসৎ পন্থা অবলম্বন করে আমাদের দেশের তৎকালীন কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে বিশেষভাবে হাওয়া ভবনকে প্রভাবিত করে পূর্ব ছাতক গ্যাসফিল্ডটি গ্রহণ করে। সে সময় একটি পরিত্যক্ত গ্যাসফিল্ড হিসেবে তাদের এটি দেওয়া হয়েছিল। আসলে এটা পরিত্যক্ত ছিল না।

২০০৫ সালে এই গ্যাসফিল্ডটি নেওয়ার ক্ষেত্রে নাইকোর ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ তদন্ত শুরু করেছিল বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।

তিনি আরও জানান, তারা তদন্তে প্রমাণ পায় যে এই নাইকো তার দেশ থেকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশ হয়ে বাংলাদেশে টাকা পাঠিয়েছিল। সে টাকা কয়েকজন ব্যক্তিকে ঘুষ হিসেবে প্রদান করা হয়েছিল।

মার্কিন প্রসিকিউটরকে দেওয়া সাক্ষ্যে এফবিআই কর্মকর্তা ডেবরা গ্রিফিত জানান, ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় নাইকোর হয়ে কর্মকাণ্ড নিয়ে সাক্ষ্য দেন সেলিম ভুঁইয়া।

আদালতকে সেলিম জানান, ২০০২ সালে মামুনের কার্যালয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই সময় মামুনের কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন নাইকো বাংলাদেশের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরিফ। তারা নাইকোর সঙ্গে সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সেলিমের সহযোগিতা চান।

সেলিম উল্লেখ করেন, গ্যাস উত্তোলনের চুক্তির বিষয়ে সহযোগিতা করলে কাশেম তাদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিচারকদের কাছে সেলিম বলেন, তার কাজ ছিল নাইকোর হয়ে সরকারের বিভিন্ন অনুমতি আদায় করা। পরে তিনি ও মামুন তার বন্ধু জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতা চান। প্রতিমন্ত্রী তাদের সহযোগিতা করতে রাজি হন। এর ফলে মামুন ও সেলিম নাইকোর চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি জানতে নিয়মিত মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।

পরে ২০০৩ সালের শেষ দিকে বাপেক্স-নাইকো জেভিএ স্বাক্ষরিত হয়। জেভিএ সফলভাবে স্বাক্ষরিত হওয়ায় সুইজারল্যান্ডে কাশেম শরিফের নিয়ন্ত্রণাধীন অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২৯ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। পরে সেখান থেকে কাসিম ৫ লাখ ডলার (প্রায় তিন কোটি টাকা) বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে সেলিমের অ্যাকাউন্টে দেন।

সেলিম জবানবন্দিতে আরও জানান, এই টাকা থেকে মামুনকে একটি পে অর্ডারের মাধ্যমে দিয়েছেন ১ লাখ ৮০ টাকা এবং বাকি টাকা নগদ ও চেকের মাধ্যমে। তিনি মনে করেন, মামুনকে দেওয়া এই টাকা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয়েছে।

সেলিম আরও জানান, মোশাররফ হোসেনকে একই অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া হয় ৬০ লাখ টাকা এবং নিজের লবিং ফি হিসেবে বাকি ৬০ লাখ টাকা রাখেন।

ডেবরা গ্রিফিত তার দেওয়া সাক্ষ্যে আরও বলেছেন, বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান এবং অন্যদের ঘুষ দেওয়ার জন্য কাশেম শরিফ নিয়োগ দিয়েছিলেন সেলিম ভুঁইয়াকে। কাশেম শরিফ নিয়ন্ত্রিত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গিয়েছে সেলিম ভুঁইয়া, বাবুল গাজী ও জামাল শামসির কছে। প্রমাণ রয়েছে এসব অর্থ ছিল ঘুষের অর্থ। যা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ অন্যদের দেওয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের হাতে দেওয়া হয়েছে।

তদন্তে উঠে এসেছে- ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যকার জেভিএ স্বাক্ষরের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) তদন্ত কর্মকর্তা কেভিন ডুগান সাক্ষ্যে জানিয়েছেন, ২০০৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, রহমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রযত্নে মো. গিয়াস উদ্দিন আল-মামুন নামের ক্রেডিট কার্ড অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা হয়েছিল। ব্যাংক স্টেটমেন্ট অনুসারে, এই অ্যাকাউন্টটি গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তারেক রহমানের কাছে থাকা ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত। কানাডার তদন্তকারীদের কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে গিয়াস উদ্দিন মামুন জানায়, রহমান ইন্ডাস্ট্রিজ ক্রেডিট কার্ডের জন্য শুধু ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এটা তারেক রহমানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কার্ড।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নিজে কেন নাইকোর দেওয়া অর্থে বেশিরভাগটা রেখেছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন যা বলেছিলেন জবানবন্দিতে, তারও উল্লেখ করেছেন সেলিম ভূঁইয়া। তার দাবি, ‘বেশিরভাগ টাকা মামুন নিজের কাছে রেখেছেন। কারণ তারেক রহমান তার সঙ্গে আছেন।’

কানাডার আরেক তদন্ত কর্মকর্তা লয়েড স্কোয়েপের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে পাস করাতে দরকার ছিল জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর। মোশাররফ হোসেন প্রকল্পের আবার পাঠান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে। খালেদা জিয়া এতে বিস্মিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, যে প্রকল্পের অনুমোদন তিনি আগেই দিয়েছেন, তা কেন আবার তার কাছে পাঠানো হলো এবং প্রকল্পটির তো বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।

লয়েড আরও বলেন, ফাইলটি মোশাররফের কাছে ফেরত যায়। তিনি ভীত হয়ে পড়েন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। কামাল সিদ্দিকী স্পষ্টভাবেই মোশাররফকে প্রকল্পটি অনুমোদন দিতে বলেন।

প্রসঙ্গত, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করার অভিযোগে এই মামলাটি করে দুদক।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক মন্ত্রী মওদুদ আহমদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ। ২০০৭ সালে ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় করা এই মামলাটির বিচার চলছে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বসানো অস্থায়ী এজলাসে।

Bootstrap Image Preview