সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নানা অনিয়ম ও ভূমিকার কথা তুলে ধরে পুলিশের কঠোর সমালোচনা করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরটির কার্যক্রম নজরদারির কথা বলে মাহবুব তালুকদারকে সমর্থন করলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাও।
আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে বৃহস্পতিবারের (২২ নভেম্বর) বিশেষ বৈঠকে এসব অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়।
বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার নির্বাচন নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার পাশাপাশি সম্প্রতি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় ও অসঙ্গতি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ৪৮ বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে তৎকালীন জাতীয় নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করি। নির্বাচন নিয়ে সেটাই ছিলো আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। কমিশনে যোগ দেওয়ার পর সেই অভিজ্ঞতা দিনে দিনে ফুল-পল্লবে পল্লবিত হয়েছে। একই সঙ্গে তাতে লেগেছে কিছু কাঁটার আঘাত। আজ আপনাদের (পুলিশ) সঙ্গে তা শেয়ার করতে চাই।
তিনি বলেন, ‘বলতে দ্বিধা নেই, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি নির্বাচনের পর বর্তমান কমিশন জনমানসে একটা আস্থার স্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে। পরবর্তীতে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট- সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়; এসবের অভিজ্ঞতা ছিলো ভিন্ন। আত্ম-বিশ্লেষনের তাগিদেই আমি গাজীপুর ও বরিশাল সিটি নির্বাচনের বিষয় তুলে ধরতে চাই।’
মাহবুব বলেন, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বা কারো দায়িত্ব পালন অবমূল্যায়ন করতে নয়, আগের সমস্যাগুলোর সমাধান ও আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই রকম সমস্যা যাতে না হয়, সেজন্যই এই আলোচনা।
গাজীপুর নির্বাচনের তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথম ঘটনা হচ্ছে, জেলা প্রশাসক ১৭৯ জনের একটি স্বাক্ষরবিহীন তালিকা রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠালে তা গ্রহণে অসম্মতি জানান তিনি। পরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে একটি ফরোয়ার্ডিংসহ তালিকাটি পাঠানো হয়, যদিও সে তালিকায় কারো স্বাক্ষর নেই।
শিরোনামহীন ওই তালিকার সঙ্গে ফরোয়ার্ডিংয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিম্নপর্যায়ের এক কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে বলে জানান মাহবুব তালুকদার।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিষয়টিও পুলিশের কার্যক্রম সম্পর্কিত। রিটার্নিং অফিসার মৌখিকভাবে বলেছেন, বিরোধী দলের মেয়রপ্রার্থীর কোনো অভিযোগপত্র প্রেরণ করা হলে পুলিশ অফিস থেকে তা গ্রহণের স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হতো না। অনেক অনুরোধের পর চিঠি গ্রহণ করা হতো। বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীর পুলিশি হয়রানি, গণগ্রেফতার, ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে।
বক্তব্যে বরিশাল সিটি নির্বাচনের নানা অনিয়ম তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার বলেন, পাঁচ সিটির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল বরিশালে। ১১টার মধ্যে প্রতীয়মান হয়ে, এভাবে ভোট সম্ভব না। নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করা হয়নি। এ সময় ওই নির্বাচনেও পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের কথা তুলে ধরেন তিনি।
বরিশাল সিটি নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির সামনে রিটার্নিং কর্মকর্তার উদ্ধৃতি তুলে ধরে কমিশনার মাহবুব বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী প্রার্থীদের পুলিশ কর্তৃক অযাচিতভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আবার সরকারি দলের প্রার্থীর আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় পুলিশকে নিস্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, উল্টো বিরোধী প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় পুলিশের অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি পুলিশ। তারা নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নির্বাচনের সময়ে প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা প্রয়োজন।
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে সরকারের নিরপেক্ষ থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার যদি সরকারি দলের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকে তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির পথ সুগম হবে। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন। পুলিশ সবার প্রতি সমান আচরণ করলে সেটা সম্ভব।
বৈঠকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন সিইসি কেএম নূরুল হুদা বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করার কথা আমরা বলিনি। এটা আপনারা করবেন না। কারণ এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে। যারা ভোটগ্রহণ করর্মকর্তা তারা বিব্রত হন। আমরা এটা চাই না।
যদি তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয় তাহলে কোনো ব্যক্তির তথ্য গোপন সূত্র ব্যবহার করে সংগ্রহ করতে নির্দেশনা দেন সিইসি।
বৈঠকে পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, দেশের বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার ও সমমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়াও বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। এ সময় নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও ছিলেন।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট হবে। তফসিল অনুযায়ী, ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। আর তা যাচাই-বাছাইয়ের শেষ তারিখ ২ ডিসেম্বর। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন প্রার্থীরা; প্রতীক বরাদ্দ হবে ১০ ডিসেম্বর।