Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৪ মঙ্গলবার, মে ২০২৪ | ৩১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কপোতাক্ষ নদ খনন ও টিআরএম বাস্তবায়নে জলাবদ্ধতা কমেছে

মীর খায়রুল আলম, দেবহাটা (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি 
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০৪ PM
আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০৪ PM

bdmorning Image Preview


তালা, পাইকগাছা, কলারোয়া, কেশবপুর, মণিরামপুর, ঝিকরগাছা, চৌগাছাসহ সুদূর দর্শনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয় কপোতাক্ষ নদ দিয়ে। নদটি খননে ও টিআরএম চালু করায় নাব্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে এসব অঞ্চল। এ  কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৫ লক্ষ অধিবাসী উপকৃত হয়েছে।

তালা উপজেলার বালিয়া গ্রামের তফেজ মোড়ল, তেঘরিয়ার মিল্টন কাশ্যপী, গৌতমকাটির লুৎফর রহমান শেখ দোহারের গোলাম মোস্তফা ও রিয়াজউদ্দীনসহ অত্র অঞ্চলের অনেকে জানান, বিগত ২০০৬ সাল থেকে কপোতাক্ষ নদের নাব্যতা সংকটের কারণে এঅঞ্চলে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। বছরের ৭/৮ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকতো এলাকার সিংহভাগ অঞ্চল। চাষাবাদ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এলাকার মানুষ ভিটে মাটি ছেড়ে আশ্রয় নিত রাস্তা, উচুবাঁধসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কর্মসংস্থানের অভাবে কেউ স্থায়ীভাবে, কেউ অস্থায়ীভাবে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। নদী খনন ও পাখিমারা বিলে টিআরএম চালু করার ফলে বর্তমানে জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্ত হয়েছে এই অঞ্চল।

তবে নদী খনন কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এলাকাবাসীর। কোন কোন জায়গায় যেনতেনভাবে নদী খনন করা হয়েছে। নদী খননের জন্য নদীর বুকে বিভিন্ন সেকশনে ক্রসবাঁধ দেয়া হয়েছিল যা যথাযথভাবে অপসারণ করা হয়নি। নদীর গভীরতা ও প্রশস্থতার ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হয়নি প্রকল্পের মূল নকশা। এছাড়া খননকৃত নদী রক্ষায় প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ক্রসড্যাম স্থাপন ও বর্ষা মৌসুমে অপসারণ করা হচ্ছেনা। খননকৃত মাটি বর্ষাকালে ধুয়ে এসে আবারও নদীবক্ষ ভরাট হচ্ছে। এ বিষয়গুলো  সমাধান সম্ভব হলে  নদী খননের উপকার বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তারা।

কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, উপুর্যপরি জলাবদ্ধতার কারণে স্থানীয় জনগণ, উত্তরণ, পানি কমিটি, কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে কপোতাক্ষ নদ খননের দাবী ওঠে। উক্ত দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ এর আওতায় ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকাবরাদ্দ প্রদান করেন। যা ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে একনেকে পাস হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকেল্পর আওতায় তালা উপজেলার বালিয়া থেকে উজানে ৯০ কি:মি: নদী খনন এবং  তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের বালিয়া ব্রীজের পশ্চিম পাশে পাখিমারা বিল অবস্থিত। বিলটির আয়তন ১৫৬১.৯৬ একর। বিলটিকে বেস্টন করে আছে তালা উপজেলার জালালপুর, খেশরা ও মাগুরা ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম।

আশেপাশের আরো ১৩/১৪ টি গ্রামের অধিবাসীদের জমি রয়েছে পাখিমারা বিলে। এস.এ রেকর্ড অনুযায়ী এখানে জমির মালিকের সংখ্যা ২ হাজার ৯৭ জন। জোয়রাধারের জন্য চারিধারে ১০.২০ কিমি বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যার নাম পেরিফেরিয়াল বাঁধ। নদী থেকে আসা জোয়ারের পানি দ্বারা চারিপাশের জনপদ বা জনবসতি যাতে প্লাবিত না হয় তার জন্য বিলের চারিধারে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধের বাইরের বা গ্রাম এলাকার বর্ষার পানি নিষ্কাশনের জন্য বাঁধের উপযুক্ত স্থানে ছোট ছোট ২২টি আউটলেট পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। নদীর সাথে বিলের সংযোগ খালের দৈর্ঘ্য ১.৫ কিমি। জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে সংযোগ খালের উপর ৪২ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি বেইলী ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। সকল অবকাঠামো নির্মাণ শেষে ২০১৫ সালের ১১ জুলাই এ বিলে টিআরএম বা জোয়ারাধার কার্যক্রম চালু করা হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, এ অঞ্চলের নদ-নদীর বৈশিষ্ট স্বতন্ত্র। এখানে রাতদিন ২৪ ঘন্টায় ২বার জোয়ার এবং ২ বার ভাটা সংঘটিত হয়। টিআরএম বাস্তবায়নের ফলে জোয়ারের সময়  বিলের মধ্যে পলিযুক্ত পানি প্রবেশ করে এবং প্রায় সমস্ত পলিই বিলের মধ্যে অবক্ষেপিত হয়। ভাটার সময়ে পলিমুক্ত পানি নেমে যায়। এতে করে পলি আর নদী বক্ষে অবক্ষেপিত হতে পারেনা। অন্যদিকে নদীর তীব্র স্রোতে নদী ক্রমশঃ গভীর ও প্রশস্ত হতে থাকে। যে কারণে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির কারণে এলাকা জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া একটি বিলে ৫/৬ বছর চালু রাখা যায়। এছাড়া খননকৃত নদীকে টিকিয়ে রাখা ও টিআরএম বিলে পর্যাপ্ত পলি অবক্ষেপনের জন্য কাটপয়েন্টের সামান্য উজানে নদীতে আড়াআড়িভাবে মাটির বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয় ক্রসড্যাম।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান একটি জটিল প্রক্রিয়া। অস্থায়ী অধিগ্রহণের আওতায় পাখিমারা বিলে জমির মালিকরা প্রতি ৩৩ শতকের বিঘায় প্রতি বছর ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন ১৪ হাজার ২৩২ টাকা এবং স্থায়ী অধিগ্রহণের আওতায় ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারিত হয়েছে প্রতি শতাংশ ৬ হাজার ৩৭৬ টাকা। ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সরকারের আহবানে সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ ও পানি কমিটি। প্রকল্পের সামাজিক অংশে তাদের মূল কাজ হলো ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত কাজে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও জীবিকায়নে সহায়তা এবং প্রকল্পের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় জনগণ ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এরফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৭২ ভাগ মানুষ এক বছরের এবং ৩৯ ভাগ মানুষ ২য় বছরের ফসলের ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করতে পেরেছে। তবে বিলের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৪ হাজার পরিবার পুর্নবাসন কর্মসূচি কিংবা কোন সহায়তা পায়নি।

এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাখিমারা বিলের ৬টি মৌজায় মোট ১১৮টি মৎস্য ঘের রয়েছে এবং তা ভেঙে নতুন নতুন ঘের স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এসব ঘের মালিকদের পক্ষ থেকে টিআরএম বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মৎস্য আহরণে সাধারণ মানুষদের বাঁধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। একদিকে ক্ষতিপূরণের অর্থ উত্তোলন করেছে আবার শক্তি প্রয়েগে মাছ চাষও করছে। ফলে এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে যা বিশৃঙ্খলার দিকে যাচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ্বাস বলেন, পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়নের মেয়াদ ৪ বছর ৩ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। বালিয়া কাটপয়েন্ট থেকে পাইকগাছার শিববাড়ী পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদ ইতোমধ্যে যথেষ্ট নাব্যতা ফিরে পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, পূর্বে কাট পয়েন্টের কাছে নদীর গভীরতা ছিল শেষ ভাটিতে মাত্র ৫/৬ ফুট, এখন সেখানে ৪৫ ফুট গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভরাট হওয়া নদীর দু’পাশ ভেঙে নদী ক্রমশই প্রশস্ত হচ্ছে।

পূর্বে সংযোগ খালের প্রশস্ততা ছিল মাত্র ১২/১৩ ফুট, এখন প্রশস্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ১২৫ ফুটের মতো হয়েছে। সংযোগ খালের নিকটবর্তী ২ কিমি এলাকাব্যাপী বিলের মধ্যে পলি জমেছে ৫০ ইঞ্চি থেকে ৫৮ ইঞ্চি, বিলের মধ্যবর্তী স্থানে ৩১ ইঞ্চি ও দুরবর্তী পশ্চিমাংশে ৩ ইঞ্চি। পলি ভরাটকৃত ভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে ঘাস জন্মাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে টিআরএম বিলে পর পর ২ বছর ধান চাষ হয়েছে। এবার প্রায় ২৫ একর জমিতে এলাকার কৃষকরা ধান চাষাবাদ করেছেন এবং মাটিতে পলি আধিক্যের কারণে ফলনও ভাল হচ্ছে। এছাড়া ভাটিতে শিবসার একটা অংশ ও কড়ুলিয়া নদীও ভরাট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে জানান তিনি।

জালালপুর ইউপি চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু বলেন, কপোতাক্ষ নদ খনন করার ফলে এলাকা জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। এতে অববাহিকার কয়েকলাখ মানুষ  উপকৃত হয়েছে।

Bootstrap Image Preview