পাইকগাছার জেলে পল্লীতে শীত মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। নতুন নৌকা ও ট্রলার তৈরি, পুরাতন নৌকা মেরামত, জাল বুনা ও জাল শুকানোর ধুম পড়েছে। জেলে পল্লীর নারী-পুরুষরা সুন্দরবনের দুবলার চরে যাওয়ার জন্য কর্মব্যস্ত দিন কাঁটাচ্ছে।
পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাটিপাড়া, রাড়–লী, শাহাপাড়া, বাঁকাসহ বিভিন্ন গ্রামের জেলে পল্লীর প্রায় ২৪০টি নৌকা বা ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুন্দরবন ও সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতির মধ্য বিরাজ করছে সারা বছরের জীবিকা অর্জনের খুশির আমেজ।
উপজেলার বোয়ালিয়া মালো পাড়ার বিশ্ব বিশ্বাস, দিপংকর বিশ্বাস, সিতেরাম, তাপস বিশ্বাস, কেনা বিশ্বাস, জয়দেব, সুজন, দয়াল মন্ডল, প্রদীপ বিশ্বাসের নতুন নৌকা তৈরি ও পুরাতন নৌকা মেরামত চলছে কপোতাক্ষ নদের তীরে বোয়ালিয়া ব্রিজের দুই পাশে।
বোয়ালিয়া মালোপাড়ার বিশ্ব বিশ্বাস ও দিপংকর বিশ্বাস জানায়, নতুন ১টি ট্রলার তৈরি করতে সর্বমোট খরচ পড়ছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। ৬০ ফুট লম্বা ১৭ ফুট চওড়া একটি ট্রলার তৈরি করতে প্রায় ৪শ সেফটি কাঠ লাগে।
সব কাট দিয়ে নৌকা তৈরি করা যায় না। এলাকায় পাওয়া যায় এমন চম্বল, বাবলা, শিরিস, মেহগনী, খৈই কাঠ দিয়ে তারা ট্রলার তৈরি করেন। প্রতি সেফটি খৈ, বাবলা ও চম্বল কাঠ ৫শ টাকা থেকে ১৫শ টাকা দরে ক্রয় করেছে। নৌকা বা ট্রলার তৈরি করতে বিভিন্নস্থান থেকে মিস্ত্রী আনতে হয়। ট্রলার তৈরিতে মিস্ত্রীদের থাকা খাওয়া বাদে প্রতিটি নতুন ট্রলার-নৌকা তৈরি বাবদ মজুরী ৭০হাজার টাকা। নৌকা বা ট্রলার তৈরির পর তাতে রং করতে প্রায় ১২টিন আলকাতরা লাগে।
পুরাতন ট্রলার-নৌকা মেরামত করতে ২০-৭০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। একটি নতুন ট্রলারে প্রায় ৩ মন পেরেক, ১শ কেজি বলই বা গজাল প্রয়োজন হয়। নৌকা বা ট্রালার তৈরি পর ইঞ্জিন বসাতে ১ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি মাছ ধরার জাল তৈরিতে তাদের খরচ পড়ে ৯০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য প্রতি ট্রলারে ২টি জালের প্রয়োজন হয়।
প্রতি ট্রলারে জাল ধরার জন্য ৫/৬ জন কর্মচারী লাগে। তাদের থাকা-খাওয়া বাদে প্রতি মাসে ৮/১০ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য নৌকা প্রতি ৫/৬ মাসে সব কিছু মিলে খরচ পড়ে প্রায় ৫/৬ লাখ টাকা।
জানা যায়, এলাকার বিভিন্ন মহাজনদের কাছ থেকে ৬ থেকে ৭ মাসের জন্য চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হয়। প্রতি ১ লাখ টাকায় মহাজনদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
জেলেপাড়ার অজয় বিশ্বাস জানান, সরকার যদি তাদেরকে ব্যাংকের মাধ্যমে মাছ ধরার জন্য সল্প সুদে বা বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে মাছ ধরে উপার্জিত অর্থ দিয়ে অতি সহজেই ঋণের টাকা পরিশোধ করে। লভ্যাংস দিয়ে সানন্দে সংসার চালানো সম্ভব। তা না হলে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া চড়া সুদের টাকা শোধ করার পর উপার্জিত টাকা আর ঘরে ফিরে আসে না।
জেলেরা বিভিন্ন মহাজনের অধীনে থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। যেসব জেলে সাগরে মাছ ধরতে যাবে তাদের পাশ নিতে হয় মহাজনদের কাছ থেকে। দুবলার চরে রওনা দেওয়ার আগে মংলা থেকে পাশ পার্মিট নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়।
এ বছর মংলা হয়ে বলেশ্বর নদী দিয়ে দুবলার চরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে করে পাইকগাছার জেলেদের প্রায় ৩ দিন বাড়তি সময় লাগবে এবং খরচ বেড়ে যাবে দ্বিগুণ। সমুদ্রে যাওয়া জন্য বন বিভাগ থেকে পাশ পারমিট নেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বন সুরক্ষার জন্য বনের ১৩টি চর নিয়ে জেলেরা যে মৎস্য পল্লী তৈরি করে তা এ বছর সীমিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর উপকূলে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে বন বিভাগ সে মত সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানান।
বোয়ালিয়া জেলে পল্লীর দিপংকর বিশ্বাস ও বিশ্বজিৎ বিশ্বাস জানায়, উপজেলার সকল ট্রলার এক সঙ্গে রওনা দিবে। মংলা হয়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে গিয়ে বাসা বেঁধে অবস্থান নিবে। জীবিকার জন্য প্রতি বছর বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বনদস্যু ও জলদস্যুদের সাথে জেলেদের জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়।