Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৬ বৃহস্পতিবার, মে ২০২৪ | ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দেশে যেভাবে বাড়ছে অতি ধনীর সংখ্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:৩৬ PM
আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:৩৬ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


দেশের অতি ধনীদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপেক্ষিতে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অতি ধনী হওয়ার প্রক্রিয়া একটি দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব রাখে। রাজনৈতিক শাসনের যে প্রক্রিয়ায় অতি ধনী হচ্ছে এতে করে অর্থনৈতিক কৌশলের সংকট হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সংকট হচ্ছে, পুঁজিবাজারে সংকট হচ্ছে, মানসম্মত শিক্ষার সংকট হচ্ছে। এ বিষয়গুলো অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

গত ৫ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স তাদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অতি ধনীর হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদন সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান উপরোক্ত মন্তব্য করেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে এখন শতকরা ১৭ দশমিক ৩ ভাগ হারে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। আর এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধনকুবের বাড়ার হার পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। ওয়েলথ-এক্স মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি ইনসাইট ভেঞ্চার পার্টনারসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ওয়েলথ এক্সের দাবি, তাদের তথ্যভাণ্ডারে ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ধনকুবেরের তথ্য রয়েছে। ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ থাকলে তাদের আল্ট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনী হিসেবে গণ্য করে সংস্থাটি। বাংলাদেশি মুদ্রামানে যাদের সম্পদ আড়াইশ’ কোটি টাকার বেশি, তারাই অতি ধনী। বাংলাদেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হারে শীর্ষে থাকলেও অতি ধনীর সংখ্যা কত তা উল্লেখ করা হয়নি। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি অবস্থানে বাংলাদেশ।

পরিসংখ্যানে বলা হয়, বাংলাদেশ ১৭.৩%, চীন ১৩.৪%, ভিয়েতনাম ১২.৭%, কেনিয়া ১১.৭%, ভারত ১০.৭%, হংকং ৯.৩%, আয়ারল্যান্ড ৯.১%, ইসরায়েল ৮.৬%, পাকিস্তান ৮.৪%, যুক্তরাষ্ট্র ৮.১%। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ধনকুবেরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৯ হাজার ৫৯৫-তে। জাপানে ১৭ হাজার ৯১৫, চীনে ১৬ হাজার ৮৭৫, জার্মানিতে ১৫ হাজার ৮০, কানাডায় ১০ হাজার ৮৪০, ফ্রান্সে ১০ হাজার ১২০, হংকংয়ে ১০ হাজার ১০, যুক্তরাজ্যে ৯ হাজার ৩৭০, সুইজারল্যান্ডে ৬ হাজার ৪০০ ও ইতালিতে ৫ হাজার ৯৬০ জন। তবে শীর্ষ ১০টি দেশ বাদে অন্য দেশগুলোয় ধনকুবেরের সংখ্যা কত, তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে জাপান, কানাডা, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র এদিক দিয়ে স্থির হয়ে আছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবার। তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৭৩৩ টাকায়, যা ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৯১ টাকা ছিল।

ওয়েলথ এক্স বলছে, তাদের তথ্যভাণ্ডারে থাকা সম্পদশালীদের আর্থিক অবস্থা, পেশাজীবন, পরিচিত সহকারী, সংশ্লিষ্টতা, পারিবারিক ইতিহাস, শিক্ষা, শখ, দানখয়রাত ইত্যাদি নানা তথ্যে এ প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৬২ হাজার ৩৮ জন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৮৭২ জন। তবে ২০১৭ সালের জুনের শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৬৮ হাজার ৮৯১ জন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) ২০১৭ সালের এক তথ্যে বলা হয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় রয়েছেন। তাদের নাম এসেছে পানামা পেপার্সে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এখন মালয়েশিয়াকে তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। ধনকুবের বাড়ার নেপথ্যে কী? ওয়েলথ এক্স শুধু বাংলাদেশে ধনকুবের বৃদ্ধির হারের খবরই প্রকাশ করেনি। তারা বলছে, এটা আশ্চর্যজনক যে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে চীন বিশ্বের এক নম্বর দেশ নয়, এ অবস্থান এখন বাংলাদেশের।

তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন বাংলাদেশে অতি ধনী বৈষম্য বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে প্রচুর পরিমাণে পুঁজি পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশে লুটপাটের সংস্কৃতি বহাল আছে। ফলে বৈষম্য বাড়ছে। একদিকে কিছু লোক সম্পদের পাহাড় গড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এই বৈষম্যটাকে আমরা ‘জিনি কোফিসিয়েন্ট’ (অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক যা কোনো দেশের আয় বা সম্পদের বণ্টনের অসমতা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়) দিয়ে মেপে পরিমাণ করে থাকি। জিনি পয়েন্ট-৩৫ হলে গ্রহণযোগ্য হয়। আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালে ‘জিনি’ ছিল পয়েন্ট ২৪। যেটাকে খুবই ভালো অবস্থা বলা যায়। তখন আমরা গরিব ছিলাম ঠিকই। কিন্তু আয় বৈষম্য ছিল না। ২০১০ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় পয়েন্ট ৩৪-এ। যেটা একটু বাড়লেও সহনীয় ছিল। এই বছর জিনি কোফিসিয়েন্ট পয়েন্ট হচ্ছে ৪৮। তার মানে এখন বাংলাদেশ অতি বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। আর পয়েন্ট ৫ পার হয়ে গেলে তো ভয়ানক বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। সহনীয় পর্যায়ে আয় বৈষম্যের দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, লন্ডন এসব দেশগুলোতে জিনি পয়েন্ট ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে থাকে। সেদিক থেকে আমাদের দেশে এতবেশি জিনি পার্থক্য দেখা যায়নি। তার মানে এখানে মুক্ত অর্থনীতির একটি ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। কল্যাণ অর্থনীতিও কিন্তু মুক্ত অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটাকে উন্নয়ন কৌশলের একটি নেতিবাচক দিক বলা যেতে পারে। আমরা সাদা চোখে প্রবৃদ্ধি দেখছি। কিন্তু সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন বা টেকশই উন্নয়নের বিষয়টি লক্ষ্য করছি না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা গ্রোথ হচ্ছে। কিন্তু এর ফলাফলটা সবার মাঝে পৌঁছেছে কিনা এ ব্যাপারে সরকারি কোনো সহায়ক নীতিমালা নেই। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে।

কিন্তু সমভাবে বা নিম্নবৃত্তরা এর কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য আয় বৈষম্য এবং সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে। বণ্টন ও সমতা ভিত্তিক উন্নয়নে আমরা কোনো জোর দিচ্ছি না। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। আমরা কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলাম। কাজেই একটি দেশ স্বাধীন হলেই তো লাভ নেই। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠাও দরকার। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল অর্থনৈতিক সমতা থাকবে। সেটা থেকে আমরা কিন্তু দূরে সরে আসছি। এটা না করলে টেকশই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এতে করে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে না।

এটা অনস্বীকার্য যে বৈষম্য বাড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। এভাবে ধনীদের সংখ্যা বাড়তে সময় লাগে ১৫০ বছর। যেখানে আমাদের দেশে মাত্র ৪৭ বছরেই বেড়ে গছে। তার মানে যাদের সামাজিক প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক সুবিধাসহ নানান ধরনের সুযোগ রয়েছে তারাই কিন্তু এই ধনীদের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন।

Bootstrap Image Preview