Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ রবিবার, মে ২০২৪ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

'ধূলা দূষণ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে'

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ১০:৫০ PM
আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ১০:৫০ PM

bdmorning Image Preview


রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, যানবাহন চলাচলের সময় ধূলা-বালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে শীতে ধূলা দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ধূলা দূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধূলা দূষণে জনদূর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধূলা দূষণ বন্ধে চাই জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ এবং দায়ীদের শাস্তি হবে বলে দাবি জানিয়েছে বক্তারা।

আজ ৬ অক্টোবর, শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ)সহ ১৬টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে মানববন্ধনে বক্তারা এসব কথা বলেন।

নাসফের সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়নার সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, সহ-সম্পাদক মো. জাহিদ হোসেন, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর সৈয়দা অনন্যা রহমান, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি মো: নাজিমউদ্দীন, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বাংলাদেশ সাইক্লিং ও হাঁটা জোট এর  মো. নিশু সাদেক প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধুলা দূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। এই মৌসুমেই হাজার হাজার ইটভাটায় ইট প্রস্তুত ও পোড়ানোর পাশাপাশি মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় রাস্তা-ঘাট খোঁড়া-খুঁড়ির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মেট্টোরেলসহ অন্যান্য মেগাপ্রকল্পের জন্য রাস্তা ও আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি, গ্যাস-পানি, বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের সময় রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, মাটি, বালি, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদনহীন ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিষ্কার করে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙ্গা, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া, ইত্যাদি ধুলা দূষণের অন্যতম উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধূলা বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলছে।

মহানগরীর চারপাশের ইটভাটাগুলো এখনো চালু হয়নি, শুষ্ক মৌসুম এখনো শুরু হয়নি তারপরও বর্তমানে ধূলা দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধূলা দূষণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ধূলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। রাস্তার পাশে দোকানের খাবার ধূলায় বিষাক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণুমিশ্রিত ধূলা ফুঁসফুসে প্রবেশ করে সর্দি, কাশি, ফুসফুস ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানী, যক্ষ্মা, এলার্জি, চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা, বমি ভাব, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ ও অশুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ধূলা দূষণের ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ধূলার কারণে দোকানের জিনিসপত্র, কম্পিউটারসহ নানা ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঘরবাড়ি আসবাবপত্রসহ কাপড় চোপড়ে ধূলা জমে যেভাবে প্রতিদিন নগর জীবনকে নোংরা করছে, তা পরিচ্ছন্ন রাখতেও নগরবাসীকে নষ্ট করতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা ও বিপুল পরিমাণ পানি এবং ডিটারজেন্ট। আর এসব ডিটারজেন্টের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে নদী, লেক, জলাধারসমূহ। যা জলজ প্রাণিসহ সামগ্রিক জীব-বৈচিত্রের জন্যও ক্ষতিকর। কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করতেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। অতিরিক্ত পানি, বিদ্যুৎ ও ডিটারজেন্ট ব্যবহারের ফলে পারিবারিকভাবে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধূলা দূষণের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৫,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ধূলা দূষণের কারণে বৃক্ষের সালোকসংশ্লেষণে বাধার সৃষ্টি হয়।

এ ছাড়াও ধূলা দূষণের ফলে মূল্যবান প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন, ইমারত, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন স্থাপনায় মরিচা পড়ে সেগুলোর আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে। এই সর্বগ্রাসী ধূলা দূষণে নগরবাসী অতিষ্ঠ, জনদূর্ভোগ চরমসীমায়। সুতরাং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় এখনই ধুলা দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই ধূলা দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় নির্দিষ্ট পরিমাণ রাস্তা-জায়গা খোঁড়া-খুঁড়ি করে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন হওয়ামাত্র তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং পর্যায়ক্রমে তা চালিয়ে যাওয়া, খোঁড়াখুঁড়ির সময় যাতে ধূলা দূষণ না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ভবন নির্মাণ এবং ভাঙ্গার সময় যথাযথ নিয়ম মেনে তা করতে হবে এবং পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে রাখা যাবে না। ড্রেনের ময়লা এবং রাস্তা ঝাড়– দিয়ে ময়লা আবর্জনা জমিয়ে না রেখে সাথে সাথে অন্যত্র অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। গৃহস্থালী ও বাজারের ময়লা সঠিক নিয়মে দ্রুত সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ময়লা পরিবহণের গাড়িগুলোতে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করে ময়লা পরিবহণ করতে হবে। ধূলা দূষণের সাথে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সর্বোপরি ধূলা দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জনদুর্ভোগ লাঘবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা এবং তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।

উল্লেখ্য, পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ কর্তৃক অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে দ্রুত অপসারণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করা হলেও এই অর্থের সঠিক ব্যবহার দৃষ্টিগোচর হয় না। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে ধূলা দূষণের কারণে শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে ভর্তি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ ভয়াবহ ধূলা দূষণের শিকার হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ০১, ০২ এবং ০৩ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে ঢাকা মহানগরীর একিউআই(এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক) যথাক্রমে ১৭৬, ১৭৭ এবং ১৬৫। অনুমোদিত একিউআই ০-৫০ ভাল, ৫১-১০০ Moderate, ১০১-১৫০ Caution,  ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর, ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। অর্থাৎ ঢাকা মহানগরীর বায়ু অস্বাস্থ্যকর।

ধূলি অপসারণে মানববন্ধে ১২টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলো হলো: ১. পরিসেবার অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে দ্রুত সরিয়ে নেয়া এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা। একাজে ব্যর্থ হলে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।
২. পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সকল পরিসেবা কার্যক্রমের জন্য রাস্তা নির্দিষ্ট সময়ে খনন করা এবং সকল সংস্থার কার্যক্রম ঐসময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা।
৩. রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা।
৪. ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী ফুটপাত বা রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা।
৫. ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিকভাবে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা নেয়া।
৬. নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার পর আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে না রাখা এবং দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেয়া।
৭. সকল আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে যানবাহন থেকে আর্বজনা রাস্তায় ছড়িয়ে না পড়ে।
৮. যানবাহন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত মানের জ্বালানী আমদানি ও ব্যবহার করা।
৯. ইট প্রস্তুতে আধুনিক প্রযুক্তি ও লো সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার করা।
১০. কলকারখানায় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১. ধুলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা।
১২. ধূলা দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা।

Bootstrap Image Preview