Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৭ মঙ্গলবার, মে ২০২৪ | ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ঢাকার রাস্তায় আবারো লেগুনা, দৈনিক ৪২ লাখ টাকাই মুখ্য কারণ!

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:০৭ AM
আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:০৭ AM

bdmorning Image Preview


বিকল্প গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করেই ডিএমপি হঠাৎ রাজধানীতে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লেগুনা চলা বন্ধ ঘোষণা করে। তাতে রাজধানীর ১৫৯টি রুটে প্রায় ছয় হাজার লেগুনা চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জনদুর্ভোগের কারণ দেখিয়ে ডিএমপি তিন দিন ধরে রাজধানীর শতাধিক রুটে আবার লেগুনা চলতে দিচ্ছে।

লেগুনা হঠাৎ বন্ধ করে আবার চালু করার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ‘নির্বাচনের আগে ভোট কমে যাবে’—এমন কথা বলে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি, পরিবহন নেতা ও পুলিশের চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতেই মূলত লেগুনা চালু করা হয়েছে। পরিবহন মালিক, চালক, লাইনম্যানসহ বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, বিভিন্ন হারে প্রতিটি লেগুনা থেকে দিনে চাঁদা তোলা হচ্ছে গড়ে ৭০০ টাকা। বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ২০০ রুটে ছয় হাজার লেগুনা থেকে দিনে চাঁদা তোলা হয়ে থাকে প্রায় ৪২ লাখ টাকা। এই চাঁদা যায় মালিক সমিতি, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের হাতে। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশকেও দিতে হয় গোপন চাঁদা। এটি মূলত মালিক সমিতির মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে।

চাঁদার বিষয়ে বাংলাদেশ অটোরিকশা অটো টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিবহন ব্যয় পরিচালনার জন্য চাঁদা নেওয়ার রীতি রয়েছে। আমাদের পায়ে পায়ে চলায় দোষ আছে। তাই পুলিশও সুবিধা নেয় বলে অভিযোগ আছে। তবে এই খাতে শৃঙ্খলা আনতে বর্তমান পুলিশ কমিশনার আন্তরিক।’

জানা গেছে, লেগুনা বন্ধ থাকলে চাঁদার উৎসও বন্ধ থাকে। ফলে তা চালু করতে উঠেপড়ে লাগে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বড় একটি অংশ। ওই নেতারা অজুহাত দেখান যে নির্বাচন সামনে রেখে গণপরিবহনের ব্যাপক সংকটের এই সময়ে লেগুনা বন্ধ রাখলে জনদুর্ভোগ তৈরি হবে এবং ভোট কমে যেতে পারে। এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা লেগুনা আবার চালু করার জন্য চাপ দেন পুলিশ প্রশাসনকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আবার চালু করা হয়েছে লেগুনা।

পুলিশ ও পরিবহন মালিক সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, গাবতলী-শ্যামলী-মহাখালী, মিরপুর-১-শ্যামলী-মহাখালী, মোহাম্মদপুর-মহাখালী-গুলশান, ফার্মগেট-মানিক মিয়া এভিনিউ-মোহাম্মদপুর এবং ফার্মগেট-মানিক মিয়া এভিনিউ-জিগাতলা রুট ছাড়া অন্যান্য রুটে বৈধ কাগজপত্র আছে—এমন লেগুনা চলাচলে পুলিশের ইঙ্গিত পান মালিকরা।

মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহনের একটি লেগুনার (ঢাকা মেট্রো-ছ-১১-৩৭২১) চালক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, প্রতিদিন ১৭টি ট্রিপ হচ্ছে। মালিককে দিনে এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এর বাইরে মালিক সমিতিকে দিনে ৪০০ টাকা এবং পাকা মসজিদের কাছে দলের এক নেতাকে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।

জানা যায়, পাকা মসজিদের কাছের ওই নেতার নাম মো. রনি। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে প্রতি লেগুনা থেকে ১০০ টাকা হারে চাঁদা তোলেন।

মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তফা গণমাধ্যমকে জানান, তাঁদের কম্পানির ২০টি লেগুনার রুট পারমিট আছে। এগুলোই চলছে ৬০ ফুট সড়কে। এর বাইরে প্রধান সড়কে কোনো লেগুনা চলছে না। তিনি জানান, ঢাকা ইন্দিরা পরিবহনের লেগুনা প্রধান সড়কে চলাচল করছে। তবে একটু পর দেখা যায়, ডিজিটাল পরিবহনের লেগুনাও আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়কে চলছে।

৬০ ফুট সড়কের আগারগাঁও রেডিও সেন্টারের কাছের মোড় থেকে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেডের একটি লেগুনায় (ঢাকা মেট্রো-ছ-১১-৩৮৭৫) ফার্মগেটের দিকে যেতে যেতে চালক মো. শাহীন বললেন, ‘দুই দিন হলো রাস্তায় লেগুনা চালাচ্ছি। লাইসেন্স আছে। রেডিও সেন্টার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। আগে ৬৫টি লেগুনা এই রুটে চলত। এখন চলছে ২০টি। আমার পরিচিত একজন মালিক তাঁর লেগুনা বন্ধ ঘোষণার আগে বেচতে চেয়েছিলেন। দাম উঠেছিল দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। এখন দাম উঠছে ৯০ হাজার টাকা।’ শাহীন জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৭০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে ফার্মগেটে ৬০০ টাকা এবং পাকা মসজিদের কাছে এক নেতার নামে ১০০ টাকা দিতে হয়। ৬০০ টাকা দিতে হয় মালিক সমিতির নামে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেড কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন চুন্নু বলেন, ‘আমরা চাঁদা তুলি না। যা তুলি তা পরিবহন পরিচালনা ব্যয়।’

ফার্মগেট থেকে নিউ মার্কেট রুটে চলাচল করতে দেখা যায় একের পর এক লেগুনা। এই রুটে আনন্দ পরিবহনের লেগুনা আগে চলত ৫০টি, এখন চলছে ২০টি।

মহাসড়কে লেগুনা চলাচলে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় গত ২৭ আগস্ট সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় লেগুনা চলাচলে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপি রাজধানীতেও লেগুনা বন্ধ করার ঘোষণা দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় লেগুনা চালু করতেই হতো। কারণ বিকল্প যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। বাসসংকট তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন রুটে লেগুনা ভরসা হয়ে উঠেছে যাত্রীদের। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘অংশীজনদের মতামত না নিয়ে এভাবে হুট করে আগেও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে তা বেশিদিন টেকেনি। এবারও টিকল না।’

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমশিনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রধান সড়কে লেগুনা চালাতে বারণ করেছি।’ লেগুনায় চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু অনিয়ম তো আছে। ধীরে ধীরে তা নিয়মে আনতে হবে। আমাদের নিয়মিত তদারকি আছে।’

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ঢাকা থেকে তিন চাকার ৪০ হাজার অটো টেম্পো তুলে দিয়ে বিকল্প হিসেবে নামানো হয়েছিল কমসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও লেগুনা। বিআরটিএর গত জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা আছে প্রায় ১৩ হাজার। এগুলোর আয়ুও শেষ হয়ে গেছে। 

 

Bootstrap Image Preview