Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৮ বুধবার, মে ২০২৪ | ২৪ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দুইশ বছর পর রুটির বদলে খিচুরি পেল জেলখানার বাসিন্দারা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২ জুলাই ২০১৯, ০৬:৩৭ PM
আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯, ০৬:৩৭ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


‘জেলখানার সম্বল/ থালা-বাটি কম্বল/ এছাড়া অন্য কিছু মেলেনা/ সকাল আর সন্ধ্যায়/ দুইটি রুটি দেয়/ রুটি খেয়ে পেট ভরেনা মা/ আমি বন্দি কারাগারে’ গানটি নিশ্চয়ই শুনেছেন! জনপ্রিয় শিল্পী মুজিব পরদেশীর গাওয়া এই গানটি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবিতে নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই কয়েদির দেয়া হত দুইটি করে রুটি আর গুঁড়। প্রায় ২০০ বছর আগের এই নিয়মে সবেমাত্র পরিবর্তন এলো। এ নিয়ে কয়েদিদের যেন উচ্ছাসের কমতি নেই। কারণ একঘেঁয়েমি খাবার থেকে মুক্তি মিললো তাদের।

১৮৬৪ সালে কারাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের কারাবন্দীরা একই মেন্যুতে সকালের নাস্তা করতো। কয়েদিরা সকালের নাস্তায় পেত ১৪ দশমিক ৫৮ গ্রাম গুঁড় এবং ১১৬ দশমিক ৬ গ্রাম আটা (সমপরিমাণ রুটি)। একই পরিমাণ গুঁড়ের সঙ্গে একজন হাজতি পেত ৮৭ দশমিক ৬৮ গ্রাম আটা (সমপরিমাণ রুটি)। সেই ব্রিটিশ আমলে বন্দিদের জন্য নির্ধারিত রুটি-গুঁড়ের বদলে এখন থেকে সকালের নাস্তায় দেয়া হবে সপ্তাহে দু’দিন ভুনা খিচুড়ি, চারদিন সবজি-রুটি এবং বাকি একদিন হালুয়া-রুটি। এতে কারাবন্দিদের নাস্তার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে জন প্রতি ৩০ টাকা। নতুন মেন্যুতে একই খাবার পাবে একজন কয়েদি ও হাজতি। তারা সপ্তাহে ২ দিন পাবে ভুনা খিচুড়ি, ৪ দিন সবজি ও রুটি এবং বাকি ১ দিন হালুয়া ও রুটি।  

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ কারাগারের এ স্লোগানের প্রতিফলন মেলে না খোদ কারাগারেই। বন্দীদশা থেকে বাইরে বেরিয়ে অনেক কয়েদি আবেগে আপ্লুত হয়ে দেশকে জানিয়েছেন কারাগারে একবেলাও তারা পেট পুরে খেতে পাননি। আর এজন্যই কারাগারের আশেপাশে প্রিয়জনরা কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করতে কিংবা খাবার দেয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে থাকেন। এ দৃশ্য এখানো চলমান। যেখানে বন্দীদের আলোর পথ দেখানোর আয়োজন তাতেই রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে হাজতি আসামিরা নানা রোগে এখানো ভুগছেন। এমনকি তারা পান না পরিমাণ মতো খাবারও।

গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে অতীতে উঠে এসেছে হাজারো কয়েদির যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। শুকনো চিঁড়ার সঙ্গে কোনো খাবার পানি সরবরাহ না থাকায় হাজতিরা যখন যন্ত্রণায়, পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন তখনো তাদের সামনে মেলে না পানি। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা যখন এই দুর্ভোগের কথা জানেন তখন বাড়ি অথবা দোকান থেকে কিনে দেন। মূলত, উপযুক্ত খাবার, পানীয়, ওষুধ ও অন্যান্য পরিসেবা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে কারাগারে থাকা কয়েদিরা প্রায়ই চুলকানি জাতীয় চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, শারীরিক দুর্বলতা, মনোবিকৃতি, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি জটিলতায় ভোগেন। 

কারামুক্ত ডজনখানেক আসামির দেয়া তথ্যমতে, সকালে পুরনো আটার আধাপোড়া একটি রুটি ও ছোট এক টুকরা গুঁড় দেয়া হত বন্দীদের ভাগ্যে। দুপুরে নিম্নমানের গন্ধযুক্ত চালের ভাত, সামান্য আলুভর্তা ও বুড়ো লাউয়ের ঝোল এবং রাতে ভাতের সঙ্গে সামান্য ডাল ও ভাজি দেওয়া হয়। এছাড়া মাঝে-মধ্যে দেয়া হয় মাছ-মাংসের খুবই ছোট টুকরো। রান্নায় লবণ পর্যন্ত ঠিকমতো দেয়া হয় না।

তবে প্রায় ২০০ বছরের এই নিয়মে পরিবর্তন আসায় খুশি কয়েদিরা। বেঙ্গল কারাবিধি যখন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ শাসকরা, তখন তাদের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন নির্বিঘ্ন করা। কারাগারে কয়েদি-হাজতিদের কঠোরতর শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিশ্চিত করা। দন্ড পাওয়া ব্যক্তিদের সংশোধনের কথা ভাবেনি তারা। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কারাগারকে কেবল শাস্তির জন্য নয়, অপরাধীকে সংশোধনের জায়গা হিসেবে গড়ে তুলছে। কয়েদিরা যাতে সাজা ভোগ শেষে নতুন মানুষ ও একজন কর্মী হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারে তার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে কারাগারে। ‘অপরাধী নয় অপরাধকে ঘৃণা করা’র আপ্তবাক্য গুরুত্ব পাচ্ছে এখন।

বাংলাদেশ এখন আর কারো উপনিবেশ নয়, কারও পদানতও নয়। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক কারাগারে কেন খাদ্যের মতো একটা মানবিক বিষয়ে অবহেলার শিকার হবেন। একজন মানুষের মনন ও চিন্তা সহজ রাখার জন্য খাদ্য এক বড় ভূমিকা পালন করে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। শারীরিক নির্যাতন একজন মানুষকে আরো বেশি দ্রোহী করে ভেতরে ভেতরে। কারাগারে আটক থাকাই একজন মানুষের জন্য বড় শাস্তি, তার ওপর তাকে নিম্নমানের ও ন্যূনতম পরিমাণ খাবার দিয়ে কষ্ট দেয়া কোনো সুবিচার হতে পারে না।

দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দিদের জন্য যে বরাদ্দ থাকে, তা দেশের বাজারদরের তুলনায় হাস্যকর। তার ওপর সেখান থেকে তছরুপের খবর আসে গণমাধ্যমে। এ ছাড়া আরো নানা অনিয়মের কথা আমরা শুনি যা একজন মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থতার পক্ষে যায় না।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩ মার্চ রংপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রংপুর কারাগার পরিদর্শনে গেলে কয়েদিরা তার কাছে সকালের নাশতা নিয়ে মানবিক আবেদন জানান। তিনি বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ বলেন বিবেচনা করতে। কারা কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ তৈরি করে গত বছরের মে মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় এটি অনুমোদন করে এবং প্রয়োজনীয় অর্থছাড়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠায়। অবশেষে, কয়েদিদের সকালের নাশতায় যোগ হলো মুখরোচক খাবার। কারাবন্দীদের বিষয় মাথায় রেখে দীর্ঘদিনের মেন্যু পরিবর্তন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রশংসায় ভাসছেন।

Bootstrap Image Preview