তসলিমা নাসরিন।। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব এরা মানবে কেন? এরা তো স্বাধীনতার পক্ষের লোক নয়। এদের বাপ-দাদারাও স্বাধীনতার পক্ষের লোক ছিল না। বরং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। তারা তো সেই লোক, যারা শত্রুসেনাকে সহযোগিতা করেছে, বাংলার লাখো মানুষকে খুন করেছে, মেয়েদের নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে। তারা তো সেই বর্বর দেশদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাকে অপমান করতো। আজ এরাও সেই পতাকাকে অপমান করছে। পতাকা হাতে নিয়ে দেশজুড়ে সন্ত্রাস করছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গোটা দেশজুড়ে স্বাধীনতাকে করছে চরম অপমান। যেখানে যত স্বাধীনতার প্রতীক ছিল, সবকিছুতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে জাতির পিতার ছবি। জ্ঞানের আলো ছড়ায় যে পাঠাগার, সেই পাঠাগারে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে। সভ্যতাকে পুড়িয়ে দিয়েছে, এরা এভাবেই পুড়িয়ে দেবে বাংলার সব গৌরব। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ মাত্র।
ভারতের মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিও উপলক্ষ মাত্র। আজ ভারতের বিশ কোটি মুসলমানকে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে বাস করতে বলা হয়, তারা কি রাজি হবে? তারা কিন্তু রাজি হবে না। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা শুধু নয়, প্রচুর মুসলমানও বর্ডার পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে চলে যায় ভারতে। বাস্তবতা হলো, মুসলিম রাষ্ট্রেও, একশ ভাগ মুসলমানের দেশেও, মুসলমানের নিরাপত্তা নেই। সে কারণে ইউরোপ-আমেরিকার অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোয় পাকাপাকিভাবে বাস করার স্বপ্ন সারা বিশ্বের মুসলমানের।
নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রদায়িক। কিন্তু যারা মোদির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে তারা কি অসাম্প্রদায়িক? সবাই জানে তারা চরম সাম্প্রদায়িক। এই চরম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মুসলমানের দুঃখে কাঁদে বটে, তবে সব মুসলমানের দুঃখে কাঁদে না। ইয়েমেনের মুসলমানদের যে সৌদি আরবের সরকার হত্যা করছে, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনও আস্ফালন তো দেখি না! চীনের সরকার যে উইঘুরের মুসলমানদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, কোনও চীনবিরোধী মিছিল তো দেখি না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান যে কুর্দি মুসলমানদের মারছে, এরদোগান বিরোধী আন্দোলন কোথায়? তাহলে এই ক্রন্দনটা সত্যিকারের ক্রন্দন নয়। এই ক্রন্দন নিতান্তই রাজনৈতিক। ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি যে আদর্শেই বিশ্বাস করুন না কেন, তিনি একজন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। তিনি বাংলাদেশে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন, যে ভারতবর্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রাখা যত না ভারতবর্ষের প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশের।
মগজধোলাই হওয়া মূর্খ লোকেরা যে দেশে একদিন আগুন জ্বালাবে; গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাকস্বাধীনতা, শিল্প-সংস্কৃতির যৎসামান্য যেটুকু পড়ে আছে, তা যে একদিন পুড়িয়ে ছাই করে দেবে, তা তো আমরা আগেই জানতাম। এত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে শেখ হাসিনা কেন জানতেন না সেটাই আশ্চর্যের। তাঁর দানে দক্ষিণায়, আদরে আহ্লাদে ধর্মান্ধতার কারখানাগুলো যে ফুলে ফেঁপে স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসীদের কারখানা হয়ে উঠবে, তা তো আমরা সাধারণ মানুষেরা জানতাম। এত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে শেখ হাসিনা কেন জানতেন না সেটাই আশ্চর্যের। তিনি যখন সিলেবাসের খৎনা করলেন, মদিনা সনদে দেশ পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিলেন, যখন মাদরাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমমানের করে দিলেন, যখন তিনি ‘কওমি মাতা’র সম্মান অর্জন করলেন, তখন তো আমরা জানিই দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জবাই করা হয়ে গেল, তখন তো জানিই ধর্মান্ধ অপশক্তির হাতে ক্ষমতার মসনদে ওঠার সিঁড়ি দেওয়া হয়ে গেল। এরাই যে একদিন এদের কওমি মাতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেবে, জানতাম। এত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে শেখ হাসিনা কেন জানতেন না সেটাই আশ্চর্যের। মুশকিল হলো, এক মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম না নিলেও, এক সন্ত্রাসী থেকে লক্ষ সন্ত্রাসী জন্ম নেয়। গুলিতে এরা মরবে না, বরং শহীদ হয়ে জান্নাতে যাওয়ার লোভে বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে। এরা মগজে হিংসে বিদ্বেষ ঘৃণা পুরে দেওয়া রোবটের মতো, এরা ধর্মান্ধতার কারখানায় তৈরি হওয়া রোবট। এখনও সময় আছে এদের মানুষ হতে সাহায্য করুন। কারখানা বন্ধ করে মানবতা সহিষ্ণুতা উদারতার পাঠশালা খুলুন।
দেশজুড়ে হেফাজতিদের সন্ত্রাস দেখে মনে পড়ছে ১৯৯৩/১৯৯৪ সালে হেফাজতিদের পূর্বসূরিরা কী করে সন্ত্রাস করেছিল, সেসব কথা। ফতোয়া জারি হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে, মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এর আগে দেশের কোনও লেখকের মাথার দাম ঘোষণা হয়নি। পরিস্থিতি ছিল বিষম আশঙ্কাজনক। ওদিকে তো আমাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানিয়ে মিছিল চলছেই, মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ, ১ লাখ থেকে ৩ লাখ লোক ‘ফাঁসি চাই, দিতে হবে’ বলে প্রতিদিন চেঁচিয়েই যাচ্ছে। সরকারের ওপর ভরসা করতে পারছে না, তখন আমাকে যে করেই হোক হাতের কাছে পেতে চাইছে তারা, নিজেরাই আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। হরতাল ডাকছে, বাস-ট্রাক ভেঙেচুরে সর্বনাশ করছে। ভয়ংকর তা-ব চালাচ্ছে। গাড়িঘোড়া বন্ধ, বাস ট্রেন বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ, অফিস আদালত বন্ধ, ইস্কুল কলেজ বন্ধ। গোটা দেশ তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। হেফাজতিদের পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে তখনকার সরকার কিছুই করেনি, বরং আমার বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করলো। হেফাজতিদের পূর্বসূরিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাকি সুড়সুড়ি লেগেছে, সুড়সুড়ি কেন লাগলো, সেই জন্য আমার বিরুদ্ধে জারি হলো গ্রেফতারি পরোয়ানা। আজ ২৭ বছর আমাকে নির্বাসন দ- দিয়ে রেখেছে খালেদা-হাসিনা সরকার। শুধু তাই নয়, হেফাজতিদের জনপ্রিয়তা দেখে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলে টানতে লাগলো তাদের। ফতোয়াবাজ মোল্লাদের কে কার দলে নেবে এ নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। বিজ্ঞ রাজনীতিকরা সেই সন্ত্রাসীদের সংসদ সদস্য পর্যন্ত বানিয়েছিলেন। রাজনীতিকদের অন্যায়ের ফল ভোগ করবে না দেশ? এই তো ভোগ করছে। আগুন জ্বলছে দেশে।
অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে নিরপরাধ এক লেখককে শাস্তি দিয়েছে দেশ। অপরাধীরা অপরাধী পয়দা করেছে। জঙ্গিতে আজ দেশ ছেয়ে গেছে। মুশকিল হলো, রাজনীতিকরা কর্মফল ভোগ করেন না, তাঁরা আরামে আয়েশেই জীবনযাপন করেন। দেশ রসাতলে গেলে দুর্ভোগ কেবল জনগণের। ভাবছি ২৭/২৮ বছর আগে যখন মৌলবাদীদের উত্থান হয়েছিল, তখন যদি তাদের ডানাটা কেটে দেওয়া হতো, তাহলে তারা কল্পনার আসমানজুড়ে এত উড়তে পারতো না। মাটির পৃথিবীতে পা রেখে চললে এত সন্ত্রাসীকে জন্ম দিত না।
ভুল হয়েছিল এদের বাপ-দাদার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা। গত ৫০ বছরে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ভুল করেছে ধর্মান্ধদের দলে টেনে, ওদের রাজনীতিকের সম্মান দিয়ে। মূর্খের সংখ্যা বেশি হলেই মূর্খের গুরুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হয় না। মূর্খ তোমাকে শেষ অবধি বাঁচাবে না, তোমাকে এবং তোমার দেশকে বরং একদিন না একদিন পাঁকে ডুবিয়ে মারবে।
প্রায়ই শুনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনও অর্থ নেই যদি জাতির নৈতিক উন্নয়নই না হয়। আর সেই নৈতিক উন্নয়নটি অর্থ করে দেয় না, সেই উন্নয়ন করে দেয় সুশিক্ষা। যদি অর্থ দিয়ে কুশিক্ষা কিনে বিতরণ করা হয়, তবে কুশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত জনগণে দেশ ছেয়ে যাবে, তারা না হয় গদিতে বসে ননীটা ছানাটা খাবে। যতই খাক, এ দেশের সত্যিকার উন্নয়ন নয়। সত্যিকার উন্নয়ন তখনই হয় যখন সমতার সমাজ গড়ে ওঠে, যখন সমানাধিকার পায় নারী, যখন কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না, যখন মানুষের মত প্রকাশের অধিকার থাকে, যখন মানুষ সত্যিকার সভ্য শিক্ষিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সমাজ তো দিন দিন পেছনে দৌড়াচ্ছে, আধুনিকতাকে অস্বীকার করে জীর্ণ পুরাতনকে আঁকড়ে ধরেছে। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনও মূল্য নেই। কিছু লোক টাকার পাহাড় গড়ে তোলে, অতঃপর দেশত্যাগ করে। যারা দরিদ্র, তারা দরিদ্রই থেকে যায়। এর নাম আর যা কিছুই হোক, উন্নয়ন নয়। দেশটিকে মানুষের বাসযোগ্য করতে হবে। তা না হলে বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানী গুণী মেধাবী কেউ দেশে বাস করতে চাইবে না। দেশ দিন দিন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় চলে যাচ্ছে। রাস্তায় লাঠিসোঁটা, রামদা, তলোয়ার নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে স্বাধীনতার শত্রুরা। সাংবাদিক, রাজনীতিক- সবাইকে আহত করেছে। আজ যদি ধর্মান্ধ লোকেরা রাজনীতি করতে নেমে পড়ে, তবে রাজনীতিকে তো এরা নষ্ট করবেই, ধর্মকেও নষ্ট করবে। ১৪০০ বছর আগে ধর্মই ছিল রাজনীতি, এখন নয়। এখন ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। রাজনীতি দেশ পরিচালনার নিয়ম-নীতি। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। এক লোক ঘোড়ায় চড়ে দেশ দখলের কায়দায় অস্ত্র হাতে নিয়ে রাস্তায় চক্কর দিয়েছে। এরা কল্পনার জগতে বাস করে। এরা অতীতে বাস করে, বর্তমানে নয়। মাদরাসায় যদি গণতন্ত্র কাকে বলে, বাক স্বাধীনতার মূল্য কী, নারীর সমানাধিকার কেন জরুরি, কেন সন্ত্রাস নিষিদ্ধ- এই শিক্ষা না দেওয়া হয়, তবে মাদরাসা থেকে চিরকাল এমন উগ্রবাদীই বেরোবে।
শত শত শিশুর হাতে জ্ঞানপাপীরা অস্ত্র দিয়েছে। দেশের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজ করার জন্য লেলিয়ে দিয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য কী নাগরিক এরা তৈরি করছে, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিশুরা মাদরাসার ভিতর বর্বর শিক্ষক দ্বারা বলাৎকারের শিকার হয়। মানবিকতা, উদারতা, সহিষ্ণুতার কোনও শিক্ষা শিশুরা পায় না। রাস্তায় এদের কীর্তিকলাপ দেখে অনুমান করা যায়, বর্বরতা আর বিদ্বেষ এদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি। একটি রুগ্ন সমাজ তৈরি হচ্ছে। একটি ভয়াবহ রুগ্ন সমাজই আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
আজ যদি প্রতিটি সন্ত্রাসী শাস্তি না পায়, সন্ত্রাসকা-ের নেপথ্যে যে সন্ত্রাসী গুরুরা ছিল, তাদের সবার যদি বিচার না হয়, যদি আগের মতো এদের ক্ষমা করে দেওয়া হয় অথবা সেই ১৯৯৪ সালের মতো অপরাধীকে আলিঙ্গন করে নিরপরাধকে শাস্তি দেওয়া হয়, তবে এরা এতই শক্তিমান হয়ে উঠবে যে একদিন দেশের ক্ষমতা এরাই ছিনিয়ে নেবে। বাংলাদেশকে আমূলে ধ্বংস করতে এটুকুই হয়তো বাকি। তাই, যত রাজনৈতিক দল আছে, সবাই আলোচনায় বসে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করুন। দেশে অরাজকতা দেখলেই অরাজনৈতিক সংগঠনও রাজনীতি করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অঙ্গন খালি পড়ে আছে বলেই ধর্মের কিতাব মুখস্থ করা মাদরাসার শিশু-কিশোররা এক একজন রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠে। এদের বাড় বেড়েছে সরকারের প্রশ্রয়ে। এই লজ্জার কথাটি সবাই জানে।
আমি মাঝে মাঝে ভাবী, আজ যদি রাজনৈতিক নেতারা ডাক দেন জনসমাবেশের, আর যদি হেফাজতিরা ডাক দেয় জনসমাবেশের, তাহলে কাদের সমাবেশে লোক বেশি হবে? আমরা সবাই এই প্রশ্নের উত্তরটি জানি, বেশি লোক হবে হেফাজতির সমাবেশে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী আছে! মুশকিল হলো, রাজনীতিকরা বড় নির্লজ্জ।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে সংগৃহীত