রাজধানীর পথ। ট্রাফিক জ্যামের বালাই নেই। ফাঁকা রাস্তা। এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। অপেক্ষায়। ইঞ্জিনের গাড়ি এ শহরে সচরাচর দেখা যায় না। তাই ভরসা জোড়া প্রাণীর আটটি পা আর দু’টো চাকার উপর। ভাবতে পারেন ভূতুড়ে কিছু বলছি কিনা? না চমকে যাবার কিছু নেই বলছি এ শহরের জনপ্রিয় ঘোড়ার গাড়ির কথা।
এখন হয়তো ভাবতে পারেন ঢাকা শহরে আবার এমন জায়গা কোথায়! নিশ্চিত থাকুন এই জ্যামের শহরকে আমি ফাঁকা রাস্তা বলবো না মোটেও।
আসলে আমি একটু স্বপ্নঘোরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন শহরের প্রাণকেন্দ্র গুলিস্থানে ঘোড়ার গাড়ির দেখা পেলো স্বপ্নকাতুর এই দু’চোখ।
আমি গ্রামের ছেলে। তাই হয়তো এমন বেমালুম স্বপ্নঘোর। রাজধানী ঢাকায় আমার দাদুর আসা যাওয়া ছিল নিয়মিত। তাঁর মুখেই ঘোড়ার গাড়ির গল্পটা শোনা। আর তাই এ প্রজন্মের ছেলে হয়েও কিছুটা চমকে যাওয়া। গল্পের শোনা সেই ঘোড়ার গাড়িটিকে স্বচক্ষে দেখে নয়নাভিরাম হলো। এখানে একটা দু’টো নয় অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ি।
সেদিন গিয়েছিলাম গুলিস্থানের বঙ্গবাজার মার্কেটে। এখানে এক্সপোর্টের কাপড় চোপড় ভালো পাওয়া যায়। স্টুডেন্ট লাইফের কেনাকাটার জন্য একেবারেই মন্দ নয়। দেশে বসে বিদেশী ভাব। গুলিস্থান মোড়ের ঘোড়ার গাড়িটার আভা চোখে নিয়ে এলাম বঙ্গবাজারে। কিছু কেনাকাটার পর হাঁটতে হাঁটতে বরিশাল প্লাজার সামনে এসে দেখলাম এখানেও বেশ কিছু ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু ঘোড়াগুলো দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হাতেগুনা দু’একটা ঘোড়া ছাড়া বাকি সবগুলো ঘোড়াই যেন রয়েছে বিষণ্ণ মনে। মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলোর মন খারাপ না হলেও শরীর খারাপ। হয়তো ঠিকমতো পরিচযা নেই একেবারেই। যে ঘোড়ার খাবারের তালিকায় থাকবে কিসমিস আর ছোলা। তাদেরকে দেয়া হচ্ছে গমের ভূসি আর কুঁড়া। হয়তো এই খাবার খেয়েই বাবুজীদের মন খারাপ। মন খারাপ হলে শরীরটাও সায় দেয় না। আবার শরীর খারাপ হলে মন। এ যেন একে অন্যের পরিপূরক। সব মিলিয়ে একটু অস্বাস্থ্যকর বাতাস যেন ছুঁয়ে গেলো।
এরই মধ্যে কথা হলো এক ঘোড়ার গাড়ি চালকের সাথে। পঞ্চাশঊর্ধ্ব এ লোকটি হালকা বেঁটে, পরনে লুঙ্গি আর চেক শার্ট। নাম নয়ন মিয়া। বয়স যখন ষোল তখন থেকে এ পেশায় আছেন তিনি।
নয়ন মিয়া জানালেন, ‘ঘোড়ার গাড়ি চালাইয়া কাঁচা চুলে পাক ধরছে। কত কিছু দেখলাম এই দুই চক্ষে। আগে যখন গাড়ি লইয়া বারাইতাম লোকজনে সম্মান দিয়া কথা কইত। আর এখন কেও পুছেও না।’
নয়ন মিয়া আরো জানান, ‘আগে রাজা-বাদশারা ঘুরতো ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে। তাই এই গাড়ির কদরও আছিলো। এহন যুগ পাল্টায় গেছে।’
ঘোড়ার গাড়ি আমাদের ঐতিহ্য। এই ঘোড়ার গাড়ি আমাদের ইতিহাস বহন করছে। কত কালের সাক্ষী হয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি। ইঞ্জিন গাড়ির আবির্ভাবে দিন দিন ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার কমলেও এর জনপ্রিয়তা আছে আগের মতই। এখনো অনেকেই সুযোগ পেলে চেপে বসেন ঘোড়ার গাড়িতে।
মানুষের রুচি, সংস্কৃতি, মনুষ্যবোধ আর প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে ঘোড়ার গাড়ি পাল্লা দিয়ে বেঁচে থাকলেও চরম দূর্ভোগে দিন পার করছেন ঘোড়ার গাড়ি মালিকরা। গন্তব্যস্থানে দ্রুত পৌঁছাতে ঘোড়ার গাড়িকে করুণার চোখেই দেখছেন অনেকে। যে কারনে কোচোয়ানদের দিন কাটছে খুবই কষ্টের মধ্যে। অনেকে ছুটির দিনে শখ করে প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ান ঘোড়ার গাড়িতে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিয়েতে ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী এই গাড়িটি।
জালাল উদ্দিন নামে এক কোচোয়ানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘সারাদিন গাড়ি চালাইয়া যে ট্যাহা (টাকা) পাই তাঁর বেশীর ভাগ চইলা যায় ঘোড়ার খাওনের পিছে। কি করমু কন ঘোড়ারে বাঁচাইতে হইলে তো খাওয়াইতে হইবই। ঘোড়া না বাঁচলে গাড়ি টানবো কেডা। তাই নিজে খাই আর না খাই ঘোড়ারে ঠিকই খাওয়াইতে হয়।’
ঢাকা শহরের রাজপথে চলা রিক্সা, বাস, ট্রাক ইত্যাদি যন্ত্রযানের বিকট শব্দের মাঝে আজও ভেসে আসে ঘোড়ার খুরের ঠক ঠক আওয়াজ। কোচোয়ানরা অধিক টাকা আয়ের আশায় নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রীর চেয়েও বেশী লোক ধারণ করে। যার ফলে নিজের চেয়েও বেশী ভার বহন করতে হয় নিবাক প্রাণীটিকে।
এক কোচোয়ানকে ঘোড়ার ও গাড়ির দাম জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, এক একটি ঘোড়ার দাম কমপক্ষে ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা। আর প্রতিটি ঘোড়ার গাড়ি বানাতে খরচ হয় ১২,০০০-১৪,০০০ টাকা।
অদূর ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ঘোড়া গাড়ির অবস্থান এমন প্রশ্নের জবাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মমিনূল হক জানান, ‘দিন দিন আমরা যন্ত্র নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। অত্যাধুনিক হওয়ার নেশায় বিভোর থাকি আমরা। এখন আমাদের কল্পনায় দানা বাঁধে বিএমডব্লিউ, অডি, আর ওয়ান ফাইভ, জিক্সার; ঘোড়ার গাড়ি নয়। তাই আমাদের তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। এখন আমরা যেভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পরছি এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঘোড়ার গাড়ি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি।’
নিজের পরিবার নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আরিফ রহমান। তাঁর সাথে কথা বললে তিনি জানান,’আমার বাসা রামপুরা। সেখানে সচরাচর ঘোড়ার গাড়ি দেখা মিলে না। বরিশালে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এখন সদরঘাটে নেমে ছোট ছেলের আবদারে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম। ভালোই লাগছে। অনেকদিন পর আবার ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরছি।’
ইট পাথরের ধূসর রঙা এই শহরজুড়ে যদি নিয়ম করে নিয়মিত শুনতে পেতাম ঘোড়ার খুরের টগবগ টগবগ। হয়তো ভালো থাকা হতো আরো।