Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ক্রাইস্টচার্চে হত্যাকাণ্ড : কোথায় শান্তি পাব?

সোহানুজ্জামান
প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০১৯, ০৬:২১ PM
আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৯, ০৬:৩২ PM

bdmorning Image Preview


ক্রাইস্টচার্চের হামলায় নিহত "মানুষের" আত্মা শান্তি পাক, সেই কামনা করছি। সমবেদনা জ্ঞাপন করছি তাঁদের পরিবারের প্রতি। এর আগেও এই ধরনের হামলায় নিহত হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের স্মরণ করছি। তারা কোন ধর্মের, তার চেয়ে বড় ব্যাপার তারা মানুষ, সকলেই রক্ত-মাংসের মানুষ। আসলে এখানে কোন ধর্মের কে অন্য কোন ধর্মের কাকে হত্যা করল সেটা বড় ব্যাপার নয়; বড় ব্যাপার এই যে, মানবতার সহজ সূত্র এবং সকল ধর্মের মূল নীতি আজ বিকৃত বলেই এমন কাণ্ড-কারখানা ঘটছে। এর পিছনে তো সবাই নেই, কেউ কেউ আছে, তাদের স্বার্থ আছে। তারই বিকৃত রূপ বহুদিন ধরে দৃশ্যমান হচ্ছে তামাম দুনিয়ায়।

খ্রিস্টান মারছে মুসলিম। মুসলিম মারছে খ্রিস্টান। হিন্দু মারছে মুসলিম। মুসলিম মারছে হিন্দু। বৌদ্ধ মারছে মুসলিম। মুসলিম পুড়িয়ে মারছে বৌদ্ধকে। আসলে সব হিন্দুই কি মুসলিমকে মারছে? আবার সব মুসলিমই কি হিন্দুকে মারছে? সব খ্রিস্টানই কি মুসলিমকে মারছে? সব বৌদ্ধই কি মুসলিম মারছে? সব মুসলিমই কি বৌদ্ধদের ঘরে আগুন দিচ্ছে?

আসলে এই ধরনের কাজকারবার করছে গুটিকতক লোকজন, একান্তই তাদের স্বার্থে, নানাভাবে ক্ষমতা চর্চার জন্য। সব হিন্দু গরু জবাইয়ের জন্য মুসলিম পিটিয়ে হত্যা করে না। সব মুসলমান আবার মসজিদে বোমা মেরে মানুষ মারে না। সব মুসলমান বৌদ্ধদের ঘরে আগুন দেয় না। সব খ্রিস্টান মুসলমান হত্যা করে না। তবে? কেউ কেউ। ক্ষমতা চর্চার জন্য এসব করে ও করায়।

অজ্ঞেয়বাদী বুদ্ধিজীবী ও তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদের লেখা বই 'কাভারিং ইসলাম' (বইটা আমি পড়েছিলাম রাইহান রাজু ভাইয়ের কাছ থেকে; ভাই আমাকে দেদার বই ধার দিয়েছেন, পড়ার জন্য) পড়ার পর আমি আর কোনোদিন "জঙ্গি" (যদিও জঙ্গি ব্যাপারটাকে আমি একক কোনো ধর্মের সাথে মেলাতে চাই না।) কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলিনি। এইসব নিয়ে আলাপ করতে একটুও আগ্রহী হইনি। একটা কথা জেনেছি, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়ার সুবাদে : দুনিয়ার সব ধর্মের শেষ কথা শান্তি। কিন্তু, মৌসুমী ভৌমিকের মতো বলতে হয়, "কোথায় শান্তি পাব কোথায় গিয়ে বল, কোথায় গিয়ে।"

মহাবীর এর নেতৃত্বে জৈন ধর্মের উদ্ভব শান্তির জন্য। নিম্ন-বর্গের মানুষের উপর ব্রাহ্মণদের অকথ্য নির্যাতন থেকে বাঁচাতে এ ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। একই সময়ে গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভবও একই কারণে। কংসের স্বেচ্ছাচারে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ, কৃষ্ণ মর্ত্যে নামলেন। রোমান প্রিফেক্ট পন্টিয়াস পাইলটেল আদেশ যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হল। কেন? যদি এ প্রশ্ন কেউ উত্থাপন করে তো বলব জুডিয়ারা আসলে চায়নি যিশু বেঁচে থাক। যিশু বাঁচলে শান্তি হবে, জুডিয়ারা শান্তি চাইনা। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত "বৈষ্ণব" ধর্মের মূল ফিচারই কিন্তু শান্তি ও অসাম্প্রদায়িকতা। ইসলামের আবির্ভাব আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে, শান্তির জন্য।

তাহলে? ধর্ম তো মানুষের জন্যই। ('অনন্ত তৃষা' পড়ে নিতে পারেন আগ্রহীরা) মানুষের জন্যই ধর্মের উদ্ভব, সম্প্রসারণ। সকল ধর্মই শেষমেশ শান্তির কথা বলে। কিন্তু ধর্মের নামে মানুষ খুন করে মানুষকে! তাহলে কী দাঁড়াল শেষমেশ: "ধর্মের জন্য মানুষ, মানুষের জন্য ধর্ম নয়।" মানুষ না থাকলে ধর্ম কোথায়? বলবেন যারা ধর্মের নামে মানুষ খুন করেন? কে শোনে কার কথা, এজেন্ট আমার মাথা ব্যথা।

Jane Cooke-এর "History's Timeline: 40,000 Year Chronology of Civilization' (দিলীপ দেবনাথের অনুবাদে 'ইতিহাসের খেরোখাতা' নামে বের হয়েছে দিব্য প্রকাশ থেকে) পড়ে দেখলাম তামাম দুনিয়ার মানুষ মনে রাখে যুদ্ধ আর রক্তকে: শান্তিকে কেউ মনে রাখে না। মনে রাখে ক্ষমতাকে, জ্ঞানকে নয়। যদি রাখতো তবে তো শান্তির ইতিহাস লেখা হতো। ইতিহাসের জনক হেরোডটাস ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখেন ইতিহাসের প্রথম বই 'দ্য হিস্ট্রি(জ)': গ্রেকো-পার্সিয়ান যুদ্ধ নিয়ে । শান্তি নিয়ে নয়। আর ইতিহাস যা পড়া হয় তাও তো "ডিনেস্টি" নিয়ে, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি নিয়ে।

যেহেতু ধর্মতন্ত্র ও ক্ষমতা-কাঠমো চলে পরস্পর পরস্পরকে মদদ দিয়ে, তাই এইরকম সমস্যা যে দুনিয়া থেকে খুব শিগগিরই চলে যাবে তা বলতে পারছি না। যুগ বদলেছে, কিন্তু 'ধর্মতন্ত্র ও ক্ষমতা-কাঠমো পরস্পর পরস্পরকে মদদ দিয়ে চলার ব্যাপারটা' আজও গেল না। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বিষয়টার উপর প্রাধান্য দিয়েই সেই অঞ্চলের ক্ষমতা-কাঠমোর লোকজন সুবিধাজনক ধর্মের সাথে আঁতাত করে চালাতে থাকে তাদের কাজকারবার। যদি নিজ দেশের বাইরে আরো দেশ কব্জায় আনতে হয়, তো সে সেভাবেই কাজকর্ম করবে। ক্ষমতা-কাঠমোর সাথে সুবিধাজনক ধর্মের পক্ষ নিবে: তাই তো দৃশ্যমান হচ্ছে বহুদিন যাবত।

ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর যার যার দিক থেকে সুবিধাজনক বিবৃতিই চোখে পড়ছে। সবাই একে অপরের ধর্মকে দোষারোপ করল। নানা শোধ প্রতিশোধের কথা শুনলাম । কারো কাছ থেকে "মানুষের" কথা শুনলাম না, শুনলাম না শান্তির কথা। অসাম্প্রদায়িক আর প্রগতিশীলদের মুখেও যে আলাপ শুনলাম: তাও ধর্ম নিয়ে। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম হবে, এই কামনাই করি। “To take revenge for Ebba Akerlund"। অর্থাৎ এবা আকেরলান্ড-এর হত্যার প্রতিশোধের জন্যে এই হামলা করেছে হত্যাকারী, এমনটা জানা গেল। কিন্তু এমনটা আর কতোদিন চলবে? তাই শেষমেশ বলতেই হচ্ছে, "কোথায় শান্তি পাব কোথায় গিয়ে বল, কোথায় গিয়ে।"

Bootstrap Image Preview