৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। সারা বিশ্বের চোখ তখন ফ্রান্সের রিভিয়েরার ছোট্ট শহর কানের দিকে। নামজাদা চলচ্চিত্র, তারকা, নির্মাতা, প্রযোজক আর সাংবাদিকদের মিলনমেলায় সাজানো এ উৎসব বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র আয়োজন হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই আন্তর্জাতিক উৎসবে ২০২৫ সালে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন ফটোসাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন, যিনি ক্যামেরার লেন্সে তুলে ধরেছেন কানের আলো ঝলমলে মুহূর্তগুলো—বিশ্বকে দেখিয়েছেন একটি বাঙালি চোখে বিশ্ব গ্ল্যামার।
বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন ফটোসাংবাদিক হিসেবে কানে অংশগ্রহণ
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরাসরি কান চলচ্চিত্র উৎসব কাভার করার ঘটনা বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক বিরল সংযোজন। সাজ্জাদ হোসেন ইতিহাস গড়েছেন সেই বিরল কাজটি করে। গ্লোবাল মিডিয়ার ভিড়ে দাঁড়িয়ে একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক হিসেবে আন্তর্জাতিক ফটোপ্রেস কার্ড নিয়ে কানের ভেন্যুতে প্রবেশ করা এবং লালগালিচার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বসেরা তারকাদের মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় ধরে রাখাটা কেবল দৃষ্টান্ত নয়, এটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি এবং গ্লোবাল ইমেজের জন্যও এক বড় অর্জন।
ফটোসাংবাদিকতা তাঁর কাছে সময়ের ভাষ্য
সাজ্জাদ শুধু একজন আলোকচিত্রী নন, তিনি একজন সময়-দ্রষ্টা। তাঁর ক্যামেরা কেবল রঙ, আলো, ফ্যাশন কিংবা গ্ল্যামার খোঁজে না—বরং আবেগ, ইতিহাস, ঘটনার প্রেক্ষাপট এবং সমাজ-সংবেদনশীল মুহূর্তগুলোকেও ধরে রাখতে চায়। এবারের কান উৎসবে তার তোলা প্রতিটি ছবি ছিল একেকটি বর্ণনামূলক গল্প। কখনও তা ছিল একজন তারকার চোখের গভীরতা, কখনওবা তাদের মুখে লুকানো মানবিকতার এক ঝলক।
তারকাদের মুহূর্ত: লেন্সের সামনে বিশ্বজুড়ে চিত্রনাট্য
সাজ্জাদের লেন্সে উঠে এসেছে বিশ্বখ্যাত তারকারা—নাটালি পোর্টম্যান, টম ক্রুজ, ক্রিস্টিনা রিচি, বোমান ইরানি, অনুপম খের সহ অনেকেই। এই তারকাদের হাসি, প্রতিক্রিয়া, হাত নাড়া কিংবা সামান্য হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকানোর মুহূর্তগুলো তিনি এমনভাবে ধরেছেন, যেন একেকটি চলমান দৃশ্য। তাঁর তোলা ছবিগুলোতে কেবলই তারকাদের উপস্থিতি নয়—তাদের মধ্যে থাকা এক ধরনের নীরবতা, উষ্ণতা ও আন্তরিকতা প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রতিটি ফ্রেমে সাজ্জাদ খুঁজেছেন গল্প। যেমন, এক মুহূর্তে নাটালি পোর্টম্যানের সংক্ষিপ্ত চোখ-মেলা; অন্যদিকে অনুপম খেরের সাংবাদিকদের প্রশ্নে দার্শনিক হাসি। এসবের বাইরে থাকা কোনো কিছুই তার দৃষ্টির বাইরে যায়নি।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আন্তর্জাতিক পরিসরে
একজন বাংলাদেশি হিসেবে কানের মতো একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাজ করা শুধুই কৃতিত্বের নয়, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক কূটনীতিও। সাজ্জাদের ছবি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যমে। এতে যেমন দেশের সম্মান বেড়েছে, তেমনি তরুণ প্রজন্মের ফটোসাংবাদিকদের জন্য নতুন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
তিনি বলেন,
“ছবিগুলো শুধু তারকাদের নয়, বরং সময়ের দলিল। আমি চেয়েছি মানুষ যেন ছবির মধ্যে দিয়ে উৎসবের ভেতরের অনুভূতিটুকু বুঝতে পারে।”
একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকের আন্তর্জাতিক অর্জন
২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল অ্যাওয়ার্ড অর্জনকারী সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম অনলাইন ফটোসাংবাদিক হিসেবে এই সম্মান পেয়েছিলেন। তাঁর কাজ বরাবরই আলাদা—দৃশ্যের গভীরে গিয়ে গল্প খোঁজেন তিনি। এবারের কান কাভার করে তিনি শুধু নিজের ঝুলিকে সমৃদ্ধ করেননি, বরং বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ইতিহাসে যুক্ত করেছেন এক নতুন অধ্যায়।
ছবির চেয়ে বেশি কিছু: ইতিহাসের হাতছানি
সাজ্জাদের তোলা ছবিগুলো কেবল একেকটি সুন্দর মুহূর্তের ফ্রেম নয়, বরং সেগুলো একটি সময়ের, একটি উৎসবের, একটি আন্তর্জাতিক মিলনমেলার নান্দনিক দলিল। ভবিষ্যতে কেউ যখন ২০২৫ সালের কান উৎসব নিয়ে গবেষণা করবে কিংবা ফিরে তাকাবে, তখন সাজ্জাদের ফ্রেমগুলো হয়ে থাকবে তথ্য, অনুভব এবং চিত্রনাট্যের সমন্বয়ে গড়া এক অনন্য দলিল হিসেবে।