Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৯ বুধবার, জুলাই ২০২৫ | ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

একটি মানবিক বিয়ের পেছনের 'অমানবিক' গল্প: অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে নাই!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল ২০২১, ০১:৪৩ PM
আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২১, ০১:৪৩ PM

bdmorning Image Preview


নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে গত শনিবার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক একজন নারীসহ অবস্থান করছেন এমন খবর পেয়ে স্থানীয় কিছু লোকজন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর কক্ষটি ঘেরাও করেন। যদিও মামুনুল হক সঙ্গে থাকা নারীকে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেন। পরে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে হেফাজতের একদল নেতা–কর্মী, মাদ্রাসাছাত্র মিছিল নিয়ে এসে রয়েল রিসোর্ট নামের ওই অবকাশযাপন কেন্দ্রটিতে ভাঙচুর চালিয়ে মামুনুলকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

ওই নারীকে 'মানবিক' কারণে বিয়েও করেছেন বলে রবিবার নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন মামুনুল হক। সেখানে  'একটি মানবিক বিয়ের গল্প' শিরোনামে লিখেছেন বিস্তারিত।

মামুনুল বলেন, হাফেজ শহিদুল ইসলাম আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন। সাংগঠনিক কাজে আমার দু-চারজন সহযোগীর অন্যতম। বেশ পুরনো আমাদের সম্পর্ক। সম্পর্কের গভীরতা পারিবারিক পরিধি পর্যন্ত । পরিবারসহ একে অপরের বাসায় যাতায়াত আমাদের দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রে  তার পারিবারিক অভিভাবকত্ব করতাম আমি।পারিবারিকভাবে খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শের জন্য তারা আমার দ্বারস্থ হতো। দুই সন্তানের ছোট সংসার নিয়ে চলছিল তাদের জীবন। একটা পর্যায়ে এসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য।

এই হেফাজত নেতা বলেন, মনোমালিন্য থেকে বাদানুবাদ এবং সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু। আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। তখন তাদের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি। তাদের উভয়ের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু কোনোভাবেই আর সেটি সম্ভব হয়নি । ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের । ছাড়াছাড়ির পর দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন হাফেজ শহীদুল ইসলাম। সেই বিবাহ আমি পড়াই। তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করছেন। সেই ঘরে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে আরেকটি সন্তান। অপরদিকে হাফেজ শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে যায় অনেকটা অসহায়। 

নিজের ফেসবুকে বলেন, এক রকমের কূলকিনারাহীন। রাগের মাথায় সংসার ভেঙে গভীর সংকটে পড়ে যান তিনি। ওই পরিস্থিতিতে তার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আমার শরণাপন্ন হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নেন। আর সেই দুঃসময়ে সহযোগিতা করার মতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না তার। ইসলামী দৃষ্টিকোণ এবং অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে আমি তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করি। জীবনের করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনার জন্য নিয়মিতই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে।

শরিয়তের দিক থেকে এই সম্পর্ক ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন মামুনুল। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় একজন বেগানা নারীর সঙ্গে এভাবে সম্পর্ক রাখাকে শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই, যত দিন তার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হবে আমার, তাকে বেগানা হিসেবে রেখে অভিভাবকত্ব করব না ,বরং ইসলামী শরিয়তের আলোকে বৈধ একটা সম্পর্ক তৈরি করে নেব। বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলি এবং এ বিষয়ে তাদেরকে জানিয়ে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের কালেমা পড়ে বিবাহ করে নিই। 

মামুনুল বলেন, দুই বছর যাবত এভাবেই মানবিক ও  ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমি তার অভিভাবকত্ব করছি এবং একজন অসহায় নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করে একটি পুণ্যের কাজ করেছি বলে বিশ্বাস করি। আমি যা বললাম, এটা আল্লাহর নামে হাজারবার শপথ করে বলতে পারব। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কুল্লামার শপথও করতে পারি।

তবে ঘটনার পর প্রায় এক ডজন অডিও-ভিডিওর ফাঁস হওয়ার কারণে প্রকাশ্যে এসেছে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের অনৈতিক কর্ম। তাঁর 'মানবিক বিয়ে' গল্পের অসারতাও প্রমাণিত হয়েছে। রবিবার মামুনুল হকের দাবি করা দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা ও ওই নারীর ছেলের কথোপকথনের একটি অডিও ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে হেফাজত নেতা মামুনুল হক সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শোনা যায় তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে আব্দুর রহমানকে। আব্দুর রহমান তার ছোট ভাই তামিমকে নিয়ে বাবার সঙ্গে খুলনায় বাস করে বলে জানা গেছে।

আব্দুর রহমান ভিডিওতে বলে, আমি তো অলরেডি বড় হয়ে গেছি, অনেক কিছু শিখছি, জানছি, ম্যাচিউরিটির একটা ভাব আইছে। আমি কিছুটা সহ্য করে নিতে পারি, কিন্তু আমার তো একটা ছোট ভাই আছে, তেরো-চৌদ্দো বছর বয়স। কেবল উঠতি বয়স। এই সময়ে মানুষের কত কথা শোনা লাগতেছে। সমাজের সামনে আইসা মুখ দেখাইতে পারতেছি না।

আব্দুর রহমান আরো বলে, আমার ছোট ভাইটা কাল রাতে যখন এই ঘটনাটা ঘটল, ও কোনো দিন আমি দেখি নাই রাত ৩ থেকে ৪টা পর্যন্ত জাইগা রইছে। কাল দেখি ওর চোখে কোনো ঘুমই নাই। ও বিষয়টা নিয়ে টোটালি মেন্টালি শকড হয়েছে। ও বাসা থেকে বের হয়ে গেছিল। বাসায় থাকলে কী উল্টাপাল্টা করবে আমি নিজেও জানি না, এইটা বইলা বের হয়ে গেছে।

আব্দুর রহমান বলে, আরো বলতে হয়, এটা আমি বলব যে আমার বাবার কর্মের ফল। আমার বাবা মানুষকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। পাগলের মতো ভালোবাসে। ওই লোকটা, কিছুদিন আগে মোল্লারহাটে একটা মাহফিল ছিল। সেখানে পুলিশ তাকে করতে দেবে না। সে একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। আমার বাবা সেটা দেখে এসে কিভাবে যে কানছে। তার আগেই বিষয়টা আমি জানছি যে আমার মায়ের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। আমি তখন হাসতে ছিলাম যে এই লোকটা যার জন্য অঝোর ধারায় কানতেছে আর ওই লোকটা (মাওলানা মামুনুল হক) এই লোকটার (বাবা শহীদুল ইসলাম) সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতেছে।

ভিডিওতে আব্দুর রহমান বলে, তারপরে যখন ওনাকে জেলে নিল, মাওলানা মামুনুল হককে জেলে নিল, তখন আমার বাবা থানার ওসি কামরুজ্জামানকে বলে যে আমাকে রেখে ওনাকে ছেড়ে দেন। কতটা ভালোবাসলে একটা মানুষকে এই কথা বলতে পারে। আর সেই লোকটা এভাবে গাদ্দারি করল। 

আব্দুর রহমান বলেন, আরো আগের ঘটনা- যখন ডিভোর্স হয়নি, আমি তখন অনেক ছোট। আমার ছোট ভাই আরো অনেক ছোট, দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিল। তখন আমার বাবা বাসায় ছিলেন না। তখন আমি ছিলাম। আমি ঘুমায়া ছিলাম নাকি বাইরে ছিলাম। আমার মা নাকি আমার ছোট ভাইকে দুগ্ধ পান করাচ্ছিল, তখন উনি আমার মায়ের রুমে ঢুকে গিয়ে একটা কুপ্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমার মা সেটা প্রত্যাখ্যন করেছিল, না এটা কোনো দিনই সম্ভব না। আপনি তো ঠকাচ্ছেন, আপনার কাছের বন্ধুকে, মানুষটাকে। সে তখন ফিরে এসেছিল। কিন্তু তার একটা তখনই মনে কামভাব ঢুকে গেছে। সে লোভ সামলাইতে পারতেছিল না। সে একটা সুযোগে ছিল, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সে এইটা বুঝতে পারে নাই।

আব্দুর রহমান আরো বলে, যখনই সুযোগ পাইছে এনাদের মধ্যে ডিসট্যান্স বাড়াইয়া দিছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তো ঝগড়া হবেই। সে তখনই নক করছে। তখন দুইজনের মধ্যে আরো ডিসট্যান্স বাড়াইয়া দিছে। এইভাবে করে সে একটা পরিবারের খুশি, ভালোবাসা, একটা পরিবারের মধ্যে যে মিলমিশ সম্পর্ক পুরোপুরি সে ধ্বংস করে দিছে। আরো যে এভাবে কত মানুষের, কত পরিবারের ভালোবাসা যে ধ্বংস করে দিছে এর কোনো ঠিক নাই।

আব্দুর রহমান আরো বলে, আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশা করব, এর যেন সঠিক বিচার হয়। আপনারা কারো অন্ধভক্ত হয়েন না। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস কইরেন না। কারণ সবারই আড়ালে আরেকটা চেহারা থাকে। এই লোকটা আলেম নামধারী মুখোশধারী একটা জানোয়ার। তার মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নেই। সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কাকে কিভাবে দুর্বল করা যায়। আমার আর কিছু বলার ভাষা নাই।

এছাড়া মামুনুল ওই নারীকে যে স্ত্রী হিসেবে দাবি করেছিলেন সেই দাবিও পণ্ড হয়ে যায় মামুনুল হকের বোন ও তার প্রথম স্ত্রীর মধ্যকার কথোপকথনের আরেকটি অডিও ফাঁসের মাধ্যমে। ওই অডিওতে মামুনুল হকের বড় বোন মামুনুল হকের স্ত্রীকে বিষয়টি নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে শিখিয়ে দেন কেউ ফোন করলে কি বলতে হবে। মামুনুল হকের বোনকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি বলবা আমার শাশুড়ি বেঁচে থাকতেই এই বিয়ে হয়েছে। আমার এতে সম্মতি ছিল। আমরা পরিবারের লোকজন সবাই তোমার সঙ্গে আছি। ঝামেলা একটু শেষ হোক।’

মামুনুলকাণ্ডে চাপের মুখে থাকা হেফাজতের দুই নেতার কথোপকথনের আরেকটি অডিও ফাঁস হয়েছে সোমবার। ওই অডিওতে মাওলানা ফজলুল করিম কাশেমী ও ফয়সাল আহমেদ নামে হেফাজতের দুই নেতা মামুনুল হকের কর্মকাণ্ডকে ভুল আখ্যায়িত করে যেকোনও মূল্যে তাদের অবস্থান শক্ত করে ধরে রাখার পরামর্শ করেন। নারীসঙ্গী নিয়ে রিসোর্টে যাওয়া মামুনুল হকের অদূরদর্শিতা আখ্যায়িত করে ওই নেতা মামুনুল হককে কিছু নসিহত করতে বলে আলোচনা করেন। মামুনুল হক ও ওই নারীকে বছিলার একটি ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছে জানিয়ে তারা আগে হেফাজতের ‘মান’ বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেন। মামুনুল হকের কর্মকাণ্ডে দুই হেফাজত নেতা ক্ষোভ প্রকাশও করেন।

Bootstrap Image Preview