Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শনিবার, জুলাই ২০২৫ | ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

চিকিৎসা ও ব্যবসার নামে পাচারের টাকায় রাজকীয় জীবন

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারী ২০২০, ০৬:০৪ PM
আপডেট: ২৯ জানুয়ারী ২০২০, ০৬:০৬ PM

bdmorning Image Preview


হুন্ডির মাধ্যমে বেড়েই চলেছে অর্থপাচার। বাংলাদেশ থেকে বছরে হুন্ডির মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে দেশে অর্থ পাঠাতেও অনেকে হন্ডির আশ্রয় নিচ্ছে। তবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের তুলনায় দেশে আসছে নামমাত্র। হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ এই লেনদেন হওয়ায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার নজরদারিতে হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হলেও কমছে না এই ব্যবসা। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে আরো বেশি নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানিতে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার কয়েক গুণ বেশি পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমদানি-রপ্তানিতে বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হচ্ছে।’

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘হুন্ডির মাধ্যমে পাচার বন্ধ করা গেলে সরকারের রাজস্ব আয় কয়েক গুণ বেড়ে যেত। হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা অর্থ পাচার না হয়ে মূল ধারার অর্থনীতিতে যুক্ত হলে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের আরো দ্রুত প্রসার হতো। দেশে নতুন কর্মসংস্থান হতো। দেশ স্বনির্ভর হতো।’

বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হুন্ডির অবৈধ ব্যবসা বন্ধে সমন্বিতভাবে কাজ করছেন।

এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্র জানায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক চক্র হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারে জড়িত। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত তদন্তে সহস্রাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার এবং দেশে অর্থ আনার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। প্রাথমিক তালিকা পেয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াড ১৭২ জন ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত শুরু করলেও বেশি দূর এগোতে পারেনি। অর্থপাচারের ঘটনায় দুই শতাধিক মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। এর মধ্যে বেশ কিছু মামলায় হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু পাচারকারীরা রয়েছেন।

গত বছর বিএফআইইউয়ের তালিকা পেয়ে সিআইডির তৎকালীন ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াডের বিশেষ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তথ্য যাচাই-বাছাই করে তদন্তসাপেক্ষে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কয়েক মাস আগে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়েছেন মোল্যা নজরুল ইসলাম। ফলে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াডের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, ‘শুধু হুন্ডি নিয়ে তদন্ত করে খুব বেশি দূর এগোনো যায়নি। হুন্ডির কিছু তদন্ত হয়েছে। আর মানি লন্ডারিংয়ের ভেতরে বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় অর্থপাচারের মামলার তদন্ত হয়েছে। অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন পূবালী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার পরিতোষ কান্তি সাহা, উত্তরার গ্লোবাল লজিস্টিক ম্যানেজমেন্টের মো. ফজলে এলাহী, আরামবাগের হাসান অ্যান্ড হারুন ট্রেডিং লিমিটেডের হারুন অর রশিদ, উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ জে ট্রেডের মোস্তফা জামাল।

সন্দেহভাজন লেনদেন করছেন সবুজবাগের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন, বায়তুল মোকাররমের জুয়েলারি ব্যবসায়ী মো. মিঠু ও পল্টনের ডেভেলপার সমির কুমার সাহা। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শান্তিনগরের অমি ইন্টারন্যাশনালের কোরবান আলী, পান্থপথের এস এম জসীম উদ্দিন, উত্তর কমলাপুরের আফরা ট্রেডিং এজেন্সির আবদুল কাদির, নয়াপল্টনের আফরিন এন্টারপ্রাইজের সেলিম উদ্দিন ও খিলগাঁওয়ের মিনার এজেন্সিস।

মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকার মতিঝিলের এএসএন মানি চেঞ্জার, মিরপুরের প্রাণ মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, গুলশান-১-এর এসএইচ মানি এক্সচেঞ্জ, বনানীর হিমু মানি এক্সচেঞ্জ, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ডি এন মানি এক্সচেঞ্জ, গুলশান-২-এর ডিপেন্ডেন্ট মানি চেঞ্জার, মতিঝিল আর কে মিশন রোডের ফেডারেল মানি চেঞ্জার, সেগুনবাগিচার বকুল মানি চেঞ্জার, মতিঝিলের মিতালী মানি চেঞ্জার ও ফকিরাপুলের আম্বিয়া মানি এক্সচেঞ্জার।

ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার মৃত আকবর আলীর ছেলে কালা জাহাঙ্গীর, একই এলাকার মৃত শমসের আলীর ছেলে মো. সিদ্দিক, বাহার উদ্দিন, আছির উদ্দিন, রশিদ শিকার, হালুয়াঘাটের সুকান্ত দত্ত, কাঞ্চন কুমার সরকার, ধোবাউড়ার ডেবিড রানা চিসিম, বুলবুল, সুরুজ মিয়া ও আবু সালেহ টিপু।

নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী ত্রিনাথ ঘোষ, সঞ্জিত সাহা, দুলাল সাহা, শ্যামল কুমার সাহা, সরোজ সাহা, শাহে আলম, নারায়ণ সাহা, নীলকৃষ্ণ দাস, প্রবীর সাহা, পরিতোষ কান্তি সাহা, লিটন সাহা ও সুশান্ত।

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় নুরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান আসাদ, মাহবুব আলম, শাহ আলম, ওসমান আলী, মো. মাসুম ও মো. মাহফুজ।মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর কাশেম শেখের ছেলে মো. আসলাম, মো. ইসলাম ও আব্দুর কাদের।

নরসিংদী সদরের মো. জহির উদ্দিন, মাধবদীর খায়ের উদ্দিন, নরসিংদী সদরের আনোয়ার হোসেন, জীবন মিয়া, শাহ আলম, রিপন মিত্র, মাধবদী বাজারের রমণী ফ্যাশনের নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়ার নাম রয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারের তালিকায়।

আর সন্দেহভাজন লেনদেনের সঙ্গে জড়িতরা হলেন—মাধবদীর বিসমিল্লাহ ট্রাভেলসের আশরাফুল ইসলাম, সদর আলী, গঙ্গাচরণ দাশ, আলী মিয়া, কমল মিত্র, বলাই পাল, তোফাজ্জল হোসেন, সমীর কুমার সাহা ও বিপুল কুমার সাহা।

নরসিংদীর মানি চেঞ্জারদের মধ্যে আছেন—মাধবদীর বিএম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মো. রফিকুল ইসলাম বাদল, নরসিংদী সদরের জহির মিয়া, শাহে আলম, সদর আলী ও মাধবদীর পাস্টিক ব্যবসায়ী মো. খায়ের।

এ ছাড়া টাঙ্গাইলের পাঁচজন, শেরপুরের ১২ জন, মানিকগঞ্জের ২৮ জন, ফরিদপুরের পাঁচজন, গোপালগঞ্জের আটজন, রাজবাড়ীর আটজন এবং মাদারীপুরের ২৫ জনের নাম উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুর, চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারতে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার বেশি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে সর্বাধিক অর্থপাচার হয় চিকিৎসা খাতে। বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ হুন্ডিসহ অনানুষ্ঠানিক পন্থায় দেশের বাইরে নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান। এ কারণে বছরে ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। বৈধভাবে এই অর্থ দেশের বাইরে যাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। এ সংক্রান্ত নীতিমালার জটিলতায় বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ হুন্ডিসহ অনানুষ্ঠানিক উপায়ে দেশের বাইরে যাচ্ছে।

হুন্ডির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হলেও দেশে আসছে নামমাত্র। প্রবাসীদের অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠান। গত বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের উদ্যোগে ‘অ্যাকসেস টু ফিন্যান্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এতে দেশের ৬৪টি জেলার দুই হাজার ৮৭২ জন মানুষ অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে রেমিট্যান্স গ্রহণ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ৩১৯ জন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট রেমিট্যান্স গ্রহীতার মধ্যে গড় হিসাবে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পান ৪.৯০ শতাংশ মানুষ। এ তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সরকারের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়।

ওই প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তদন্ত প্রতিবেদন ও সন্দেহজনক লেনদেনের ৬৭৭টি প্রতিবেদন বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠায় বিএফআইইউ। এর মধ্যে হুন্ডিসংক্রান্ত লেনদেনের প্রতিবেদন ছিল ৬০৯টি।

জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হুন্ডির বিষয়টি পুরোপুরি বেআইনি। এটা পুরোপুরি হয়তো নির্মূল করা যাবে না, তবে এটা রোধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তৎপরতা অব্যাহত আছে।’

তিনি জানান, দেশে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস চালুর পর মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে এজেন্টের মাধ্যমে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছিল রেমিট্যান্সের ওপর। ওই সময় এগুলোর ওপর অনেক কাজ করা হয়েছে। অনেকগুলো মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস সেবা দানকারী এজেন্টের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে।

Bootstrap Image Preview