সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাস করার নিয়ম থাকলেও ঝালকাঠির কোয়ার্টারের অনেক ভবনে অবৈধভাবে থাকছেন বহিরাগতরা। আর্থিকভাবে নিজেরা লাভবান হয়ে একটি অসাধু চক্র এসব বরাদ্দহীন অবৈধদের থাকার ব্যবস্থা করছেন। অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব।
জানা গেছে, সরকারি চাকরিজীবীদের ঝালকাঠি কোয়ার্টারের চাহিদা থাকলেও নানা অজুহাতে তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে কোয়ার্টার তদারকির দায়িত্বে থাকা একটি চক্রটি। আর এসব কোয়ার্টারে দিনমজুরসহ অন্য বহিরাগতদের থাকার ব্যবস্থা করছে চক্রটি। কোয়ার্টারে অবৈধদের থাকতে দিয়ে এ চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
বহিরাগতদের কোয়ার্টার বরাদ্দ দেওয়ায় নষ্ট হচ্ছে কোয়ার্টার এলাকার পরিবেশ। ঝালকাঠির গণপূর্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলীকে (এসও) দিয়ে এই অনিয়ম করালেও সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী এসবের মূল নেপথ্য নায়ক হিসেবে কাজ করছেন। আর এদের একজন গণপূর্ত মন্ত্রীর এলাকার লোক এবং অপরজন ঘনিষ্ট বলে দোর্দণ্ড দাপটে এসব অনিয়ম করে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্তমন্ত্রীর এলাকার লোক পরিচয় দানকারী এসও অনিরুদ্ধ মণ্ডলের নেতৃত্বে ঝালকাঠির গণপূর্ত এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি চক্র ঝালকাঠির স্টাফ কোয়ার্টার অবৈধপন্থায় চুক্তিভিত্তিক ভাড়া দিয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে ফায়দা নিচ্ছেন। তাছাড়া বরাদ্দ পাওয়া কোনো কর্মকর্তা তার বরাদ্দ বাতিল করলে এ চক্রটি কোয়ার্টার বরাদ্দ দেওয়া কমিটির কাছে তা উপস্থাপন না করে নিজেরা তা ভাড়া দেয়। এমনকি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা কোয়ার্টারেও অবৈধভাবে ভাড়া দিচ্ছে এ চক্রটি। ঝালকাঠির গণপূর্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসও), এক উচ্চমান সহকারী এবং বিদ্যুতের সহকারী প্রকৌশলী এ চক্রের মূল হোতা বলে অভিযোগে প্রকাশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় ইতোমধ্যেই এ-১ টাইপ কোয়ার্টার পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও অবৈধভাবে এ ভবনের ১ ও ২ নম্বর ফ্লাটে বসবাস করছেন ঝালকাঠি জেলা জজ কোর্টের অফিস সহকারী ইউসুফ আলী খান। গাড়ি চালক মাহাবুবুর রহমান বাস করেন এ ভবনের ৫ও ৬ নম্বর ফ্লাটে। গণপূর্তের অফিস সহকারী আব্দুল জলিল বসবাস করেন ৩ ও ৪ নম্বর ফ্লাটে। এদের প্রত্যেকেই দুটি করে ফ্লাট নিয়ে থাকছেন অথচ বৈধভাবে একজনের কাছে একটির বেশি ফ্লাট বরাদ্দ দেওয়া হয় না। ভবনটিতে আরো থাকছেন জজ কোর্টের মাস্টার রোল কর্মচারী সুমন রায়হান ১০নম্বর ফ্লাটে এবং রেজাউল বসবাস করছেন ৭ নম্বর ফ্লাটে।
বি-টাইপ ২ নম্বর ভবনে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবুল কালাম, মো. ফিরোজ, থানা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী ইসমত আরা বেগম, গণপূর্তের মাস্টার রোল কর্মচারী মো. বাবুল বসবাস করছেন।
এছাড়া ডি-টাইপ ২ নম্বর ভবনের ১ নম্বর ফ্লাটে রয়েছেন আবুল কালাম, আলম হোসেনসহ ছয়/সাত জন দিনমজুর। জেলা জজ কোর্টের পেস্কার আবুল কালাম আজাদ থাকছেন ৬ নম্বর ফ্লাটে। ভবনের ৩ নম্বর ফ্লাটে বসবাস করছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের স্ট্যানো এবং ৪ নম্বর ফ্লাটে রয়েছেন একই অফিসের ড্রাইভার মাহাবুব।
অপরদিকে ই-টাইপ ভবনের ১ নম্বর ফ্লাটে বসবাস করছেন জেলা প্রশাসকের গাড়ি চালক মো: হানিফ। এছাড়াও এখানকার অন্যান্য কোয়ার্টারে আরো অনেকেই এভাবে অবৈধ পন্থায় থাকছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, এসব ভবনে যারা থাকছেন তারা প্রত্যেকেই বিদ্যুৎ ও গণপূর্ত বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে মাসিক ভাড়া চুক্তি করে থাকছেন। আর এসব টাকা মাসের নির্দিষ্ট তারিখে সিন্ডিকেটের সদস্যরা মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব কোয়ার্টারে বসবাসকারী একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রতি মাসে তারা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তার নির্ধারিত টাকা তাদের নির্দিষ্ট লোকের কাছে পরিশোধ করতে হয়। তাছাড়া আলাদাভাবে বিদ্যুৎ বিল হিসাবে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিতে হয় তাদের।
এ ব্যাপারে ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগের এসও অনিরুদ্ধ মণ্ডল বলেন, ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় এ-১ টাইপ ভবনটি ইতোমধ্যেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। পরিত্যক্ত এ ভবনসহ কোয়ার্টারের অন্য ভবনে বহিরাগতরা থাকছেন মর্মে স্বীকার করে বিষয়টি বরাদ্দ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসককে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
বহিরাগতরা কিভাবে এসব কোয়ার্টার বরাদ্দ পাচ্ছেন এমন প্রশ্নে বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে অনিরুদ্ধ মণ্ডল বলেন, বহিরাগতদের অবৈধভাবে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতে দিয়ে প্রতি মাসে টাকা নিচ্ছি এ কথা সত্য নয়।
এ ব্যাপারে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুন অর রশিদ বলেন, আমি জানি, পরিত্যক্ত ভবনের পাহারাদার হিসেবে একজনকে রাখা হয়েছে। অন্যান্য ভবনে বহিরাগতরা থাকছে বলে আমার জানা নেই। তদন্ত করে বহিরাগতদের পেলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।
বিষয়টি নিয়ে ঝালকাঠি বিদ্যুৎ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম বলেন, স্টাফ কোয়ার্টারের কোনো ভবন পরিত্যক্ত হলে তা বিদ্যুৎ বিভাগকে গণপূর্ত বিভাগ জানালে দ্রুতই তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধভাবে কোয়ার্টারে থাকাদের কাছ থেকে কে বা কারা টাকা নিচ্ছে তা আমার জানা নেই। তবে আমার অফিসের কেউ এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
সরকারি কোয়ার্টার বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ঝালকাঠির জেলা প্রশাসককে মো. জোহর আলী জানান, বিষয়টি আমি জানতাম না। খোঁজ- খবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।