Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ রবিবার, জুলাই ২০২৫ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

'লিবিয়ায় নিয়ে রড দিয়ে পেটানো হত বাংলাদেশি কর্মীদের, উপড়ে ফেলা হত পায়ের নখ'

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০১৯, ০১:০১ PM
আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯, ০১:১৭ PM

bdmorning Image Preview


নাটোরের নলডাঙ্গার বাসিন্দা মমিনুল। পরিবারের বড় সন্তান খুব বেশি পড়াশোনা করেননি। গ্রামে তার মতো অনেকেই বিদেশ গিয়ে সংসারের চাকা ঘুরিয়েছে। তিনিও যাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। শেষটায় প্রতিবেশী দালাল গুলজারের মালয়েশিয়া ভালো চাকরির প্রলোভনে পড়েন। দেন ৪ লাখ টাকাও। প্রথমে না বুঝলেও গত ১২ ফেব্রুয়ারি দালালদের কথামতো লাগেজ নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে হোঁচট খান মমিনুল।

মমিনুল বলেন, ওরা বিমানবন্দরের বাইরে আমাকে বলে- তোমার মালয়েশিয়া ফ্লাইট হবে। ভেতরে গিয়ে জানতে পারি আমার দুবাইয়ের ফ্লাইট। দালাল গুলজারকে ফোন দিলাম, বলল বাবা যাও কোনো সমস্যা নাই। লিবিয়া খোলা আছে, বৈধভাবে থাকবা, কোনো সমস্যা নেই। এরপর ভয়ে ভয়ে উঠে পড়ি দুবাইগামী ফ্লাইটে। দুবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর জাহিদ নামে এক বাংলাদেশি তরুণ আমাকে রিসিভ করে। পরে দুবাই থেকে বাসে করে নিয়ে যায় তিউনিসিয়ায়। সেখান থেকে একইভাবে নিয়ে যায় লিবিয়ার বেনগাজি শহর লাগোয়া মরুভূমিতে। ১৬ ফেব্রুয়ারি সেখানে পৌঁছে বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। দেখি সেখানে আটকে আছেন বাংলাদেশি শতাধিক তরুণ। তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি এটি দালাল চক্রের (বাংলাদেশি) নির্যাতন সেল।

তিনি জানান, বেনগাজি শহরের পাশের মরুভূমিতে ১৫-২০টি তাঁবু। এগুলো যে মাফিয়াদের বাংলাদেশি নির্যাতনের টর্চার সেল তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে ভেতরে গেলে আঁতকে উঠতে হয়। তখন আর ফেরার সুযোগ থাকে না। সেখানে হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে কাউকে। কাউকে পেটানো হয় রড দিয়ে। লোহার পাইপ দিয়ে কারও পায়ের তালুতে, হাঁটুতে পেটানো হয়। শরীরের গিরায় গিরায় আঘাত করা হয়। লোহা গরম করে সেঁকা আর পায়ের আঙুলের নখ উঠিয়ে ফেলার মতো বর্বরতাও চলে সেখানে।

মরুভূমির বালুতে কোমর পর্যন্ত পুঁতে রাখা হয় রোদে। খাবার তো দেয়ই না, ‘পানি পানি’ করে চিৎকার করলেও দেয় না এক ফোঁটা পানি। এ অবস্থায় মাফিয়া চক্র নির্যাতিতদের স্বজনদের ফোন করে দাবি করে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ। এ দেশে চক্রের কারও নামে বিকাশ কিংবা ইউক্যাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিতে বলা হয়। মুক্তিপণ দিয়েও মেলে না মুক্তি। আবারও মুক্তিপণ দাবি করে চলে নির্যাতন। লিবিয়ার বেনগাজির একটি টর্চার সেল থেকে ফিরে আসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে এভাবেই জানিয়েছেন সেখানকার নির্যাতনের কাহিনী।

মমিনুল বলেন, লিবিয়ায় যাওয়ার পর ওখানকার এক দালাল ছিল লিবিয়ান। ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে সে আমাকে পায়ে বুট জুতা পরে লাথি মারতে থাকে। এরপর লোহার পাইপ দিয়ে হাঁটু, পায়ের তলায় ও গিরায় গিরায় পেটায়। এভাবে ১০ মিনিট পেটাতে থাকে। পরদিন সকালে বাড়িতে ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা নিতে বলল। নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আমি দালালদের কথায় রাজি হই। পরে দালাল জাহিদের (নির্যাতন সেলে অবস্থানকারী) ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলি। মা আমাকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে দ্রুত দালাল চক্রের সদস্য নওগাঁর ছাত্তারের হাতে ১ লাখ টাকা তুলে দেন। কিন্তু টাকা দিয়েও মিলছিল না মুক্তি। তারা আরও দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় আমার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন।

 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়শী বলেন, মমিনুলের মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে দালাল চক্রের তিন সদস্য নোয়াখালীর সফিউল্লাহ, বরগুনার এহসান রাসেল ও নওগাঁর গুলজার হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। দু’দিনের রিমান্ডে এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে কৌশলে ভিজিট ভিসায় নিরীহ লোকদের লিবিয়ায় যাওয়ার কথা। পরে সেলে আটক রেখে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মশিউর রহমান বলেন, গ্রেফতার সফিউল্লাহর মাধ্যমে লিবিয়ায় টর্চার সেলে অবস্থানকারী জাহিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। পরে সফিউল্লাহর নির্দেশেই জাহিদ ঢাকাগামী বিমানের টিকিট কেটে মমিনুলকে দেশে পাঠায়। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়েছে।

তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতায় ওই টর্চার সেল থেকে আরও ৪০ বাংলাদেশি মুক্ত হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা স্বিকার করেছে, তাদের মতো আরও বেশ কয়েকটি চক্র রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা পুলিশ তৎপর আছে।

Bootstrap Image Preview