ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ব্যবহারে রাষ্ট্রকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে।
শনিবার রাজধানী ঢাকার শিশু কল্যাণ পরিষদে বিশ্ব শিক্ষা অধিকার আন্দোলন (মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস) আয়োজিত ‘রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ভাষায় পরিণত করতে যা প্রয়োজন তা এই সরকার করবে বলে আশা রাখি। কেননা এই দলটিই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে বিশ্বের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।
প্রধান অতিথি বলেন, আমার ক্লাস থাকার কারণে সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারলাম না। মোবাইলে বক্তব্য দেয়ার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করছি। আগামীতে আপনাদের সাথে থাকবো।
ড. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। আমাদের অসংখ্য অর্জন তার মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাসা দিবস অন্যতম।
ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মরমিকবি ও রাষ্ট্রসেবক ইঞ্জিনিয়ার সাবির আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভাষাসৈনিক একুশে পদকপ্রাপ্ত ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ড. জসীম উদ্দিন আহমদ, প্রমিত উচ্চারণ বিশারদ, গবেষক, নাট্যকার ও আবৃত্তিশিল্পী মীর বরকত, ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক, গবেষক এম আর মাহবুব, এমডব্লিউইআরের আহ্বায়ক ফারুক আহমাদ আরিফ, মো. নুর হোসেন ইমন, জীম মণ্ডল, এমদাদুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী মিশন। আসাদুল্লা লায়ন ও রায়হান শোভনের উপস্থাপনায় আরো বক্তব্য রাখেন আব্দুল ওয়াদুদ, নাসিম শুভ, আব্দুল্লাহ আল মাসুম, কামরুল ইসলাম, সুলতান মাহমুদ আরিফ, ইলিয়াস শান্ত, ঊষা সরদার, জান্নাত প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে ভাষাসৈনিক ইঞ্জিনিয়ার সাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, মায়ের মতো মাতৃভাষারও যত্ন নিতে হবে।
তিনি বলেন, মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে আবেগ ও বিবেক জড়িত। পাকিস্তানীরা সিএসসি পরীক্ষায় অনেক ভাষার ব্যবহার রাখলেও বাংলা ভাষার স্থান রাখেননি। যার ফলে আন্দোলনের দানা বাধতে থাকে। তার ফলে এক সময় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মতো বিষাদ ঘটনার জন্ম হয়। এই ভাষা আন্দোলনের পথে হেঁটেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
ভাষাসৈনিক সাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, ১৯৪৮ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্না যখন বলেছিলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র’। আমরা শিক্ষার্থীরা তার সমাবেশ প্রত্যাখান করে চলে এসেছিলাম।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনসহ জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করতে হবে।
ভাষাসৈনিক সাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, আলোকিত অন্তর ছাড়া মানুষের বিকাশ হয় না। আর এর জন্যই দরকার ভাষার। বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ভাষাসৈনিক ড. জসীম উদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে একটি ‘বাংলা ভাষা পরিষদ’ গঠন করতে হবে। যেখানে বাংলা ভাষার প্রমিতরুপ প্রদান ও বিকৃতি থেকে রক্ষা যায়। তবে এখানে প্রাচীন শব্দগুলো থাকতে হবে। আঞ্চলিক বিষয়গুলোকেও স্থান দেয়া হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলা ভাষার অবক্ষয় চলছে। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে কি এক আজব ভাষা তৈরি করা হয়েছে।
এই ভাষাসৈনিক বলেন, বাংলা ভাষা আগামীতে আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত হবে। কারণ বাংলার মতো সুললিত ভাষা বিশ্বের আর কোনটিই নয়। তিনি ভাষাসৈনিকদের প্রথম শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা প্রদানের দাবি জানান।
মীর বরকত বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে তরুণ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমরা চাই বাংলা ভাষার প্রমিত উচ্চারণে তারা এগিয়ে আসবে। এখন গণমাধ্যমে যা ব্যবহার হচ্ছে তাকে ক্যাম্পাস ভাষা বলে অভিহিত করা যায়। কেননা বাংলা- ইংরেজি মিলিয়ে বাংলা ভাষার অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের আঞ্চলিক ভাষা খুব শক্তিশালী। এগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।
ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব বলেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আইন করেছিলেন সরকার কার্যালয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আমরা আশা করি এই আইনটি দ্রুত কার্যকরে ব্যবস্থা নিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি ভাষানীতি করার জন্যে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, পাটনীতি, বাণিজ্যনীতিসহ কত নীতি হয় অথচ আমাদের ভাষানীতি নেই। তাই সরকারকে অচিরেই ভাষানীতি তৈরিতে হাত দিতে অনুরোধ করছি।
ফারুক আহমাদ আরিফ সংগঠনটির পক্ষ থেকে ৫টি দাবি তুলে ধরেন সরকারের কাছে। দাবিগুলো হচ্ছে ১. অফিস, আদালতসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বাহন করতে হবে। ২. ভাষাসৈনিকদের প্রতি হামলা ও শহিদদের হত্যাকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। ৩. অসচ্ছল ভাষা শহিদ ও ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা প্রদানসহ আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে। ৪. কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাশে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর স্থাপন ও ভাষাসৈনিকদের একটি গেজেট প্রণয়ন করতে হবে। ৫. ভাষা শহিদ ও ভাষাসৈনিকদের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ও গ্রন্থাগারের নামকরণ করতে হবে।