Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১১ সোমবার, আগষ্ট ২০২৫ | ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

বানিয়াচংয়ে নিষিদ্ধ নোট-গাইডের ছড়াছড়ি, মানা হচ্ছেনা সরকারি নির্দেশনা

রায়হান উদ্দিন সুমন, বানিয়াচং (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৭:৫৫ PM
আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৭:৫৫ PM

bdmorning Image Preview


শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। উদ্দেশ্য মূল পাঠ্যবই পড়েই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারবে। জাতির কল্যাণ বিবেচনায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সারাদেশের ন্যায় বানিয়াচং উপজেলায় বইয়ের বাজারগুলিতে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে অবৈধ নোট ও গাইড বই। অথচ এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসনের নেই কোন নজরদারী।

বাজারের কিছু অসাধু প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে এসব নোট ও গাইড বই ছড়িয়ে পড়ছে। পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। এ অবস্থা কয়েক বছর ধরে চলে আসলেও বর্তমানে তা বেড়ে গেছে সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে। এ পদ্ধতিতে পাঠদানে শিক্ষকরা যথেষ্ট দক্ষ নন বলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হচ্ছে নোট ও গাইড বই নির্ভর হতে হয়।

এভাবেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা থেকে অপর দিকে লাভবান হচ্ছেন অসাধু নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীরা। আর সেই সাথে শিক্ষকরাও পিছিয়ে থাকবেন কেনো ব্যবসায়ীদের সেই কাঁচা টাকা পকেটস্থ করতে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে সেসব বই পাঠ্যতালিকাভুক্তও করছেন তারা।

নতুন বছরের শুরুতেই এবার বানিয়াচং সদর ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে লাইব্রেরীগুলোতে প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারছে বিক্রি হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণির নিষিদ্ধ ঘোষিত নোট-গাইড বই। কৌশলে পাল্টে ফেলা হয়েছে নাম আর মলাট। নোট বই বিক্রি হচ্ছে সহায়িকা অথবা একের মধ্যে এক, দুই, পাঁচ এমন সব বাহারি নামে।

এসব কর্মকাণ্ডে একদিকে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে নিষিদ্ধ বাহানায় ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের কাছে বেশি দামে এসব নোট-গাইড বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন অসাধু লাইব্রেরী মালিকরা। আর একই কায়দায় চলছে ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণের ব্যবসা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সরকারি-বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা বই কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ সব নিন্মমানের নোট-গাইড ও গ্রামার বইয়ের নাম প্রেসক্রাইব করছেন। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার অনুপাতে পরিমাপ হয় প্রকাশনীগুলোর ঘুষের টাকার। যত বেশি ছাত্রছাত্রী তত বেশি টাকা, অফার, উপহার।

উপজেলা সদরের বাসিন্দা কোরবান আলী। রবিবার একটি লাইব্রেরীতে এসেছেন নোট-গাইড ও গ্রামার বই কিনতে। কথা হল তার সাথে। তিনি জানালেন, তার সন্তান একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় তিনি বললেন, সরকার আমার সন্তানের সব বই বিনামূল্যে দিল, আর স্কুলের স্যারদের কথা অনুযায়ী আমাকে ৩টি বই কিনতে ৯৩০ টাকা খরচ করতে হল, কি বা করার আছে? আমরা তো জিম্মি! প্রশাসনের উদাসীনতা আর নীরবতায় বিপাকে পড়া অভিভাবকরা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের।

সরেজমিনে কয়েকটি লাইব্রেরীতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বানিয়াচংয়ের লাইব্রেরী মালিকরা আগের মতো আর গোপনে নোট ও গাইড বই বিক্রি করছেন না। প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে আর শিক্ষকদের প্রেসক্রিপশনে (লেখা তালিকা অনুযায়ী) প্রকাশ্যেই চড়া দামে বিক্রি করছেন নিষিদ্ধ গাইড নোট ও গ্রামার বই। এতে বিক্রেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা।

ইসমাইল হোসেন নামে এক অভিভাবক আক্ষেপ করে বললেন, আমার ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাসের প্রথমদিনেই শিক্ষকরা তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে নোট-গাইডের তালিকা। সেসব বই কোন লাইব্রেরিতে পাওয়া যাবে তার নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় থাকা তিনটি গাইড বইয়ের দাম প্রায় নয়শ টাকা। যা কিনা অন্য কোনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা যা চাইছেন সে দামেই কিনতে হচ্ছে। কোনো উপায় নেই। ইসমাইল হোসেন ক্ষোভে অভিমানে সন্তানের জন্য বই না কিনেই বাড়ি ফিরছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক জানান, আমরা কি করব, লাইব্রেরীগুলোতে বিভিন্ন প্রকাশনীর নোট ও গাইড বই বিক্রি করা হচ্ছে। আর আমরাও নোট-গাইড বইয়ের তালিকা ছাত্রছাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। এর জন্য দায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ প্রকাশনীগুলোর লোভনীয় অফারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অনুমোদিত লেখক ও প্রকাশনীর ইংরেজী গ্রামার, দ্রুত পঠন (রেপিড রিডার) ও ব্যাকরণের তালিকা ছাত্রছাত্রীদের না দিয়ে লাইব্রেরি মালিকদের ইচ্ছেই চাপিয়ে দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের ওপর।

কয়েকজন অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের তেমন শেখায় না, তারা প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জেলার সরকারি, আধা-সরকারি স্কুল, মাদ্রাসা শিক্ষকদের শতকরা ৮০ ভাগ প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত।

তারা আরো জানান, স্কুলে পড়াশুনা আগের মত হয় না। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা গত ৫ বছরের পাবলিক পরীক্ষায় বানিয়াচংয়ে দুটি সরকারি বিদ্যালয়সহ গোটা উপজেলার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে বলেন।

অভিভাবকরা আক্ষেপ করে বলেন, দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে বানিয়াচংয়ে এ পর্যন্ত যেসব বিদ্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট বইয়ের তালিকা শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে তা কি ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবি অনুমোদিত? এটা ভেবে কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

বানিয়াচং জনাব আলী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সাফিউজ্জামান খান বলেন, নোট-গাইড পড়লে পরিপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যাবে না। এমনকি নোট-গাইড থেকে শিক্ষার্থীরা যে বিষয়টি পড়ছে, সেটির সম্পর্কেও ধারণা পাবে না। স্ব-কীয়তা অর্জনের জন্য তিনি মূল বই পড়ার পরামর্শ দেন।

তিনি আরো বলেন, নোট-গাইড বন্ধ করতে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু আমাদের দেশে আইন আছে, তার প্রয়োগ নেই।

বানিয়াচংয়ে এসব অবৈধ নোট-গাইড বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের জরুরীভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন অভিভাবক, সুশিল সমাজ ও অভিজ্ঞ মহল।

এ বিষয়ে বানিয়াচং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কাওছার শোকরানা বলেন, কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বই ব্যবহারের জন্য উৎসাহ প্রদান করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

Bootstrap Image Preview