Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৫ মঙ্গলবার, আগষ্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

জেনে নিন প্রধান ৪ ধর্মের বিবাহের নিয়মকানুন

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ০৮:২৮ PM
আপডেট: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ০৮:২৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বিয়ে। এর মাধ্যেমেই একজন নর এবং একজন নারী পূর্ণতা লাভ করে। যার মধ্য দিয়ে সমাজ একজন পুরুষকে একজন নারীর সাথে অতি ঘনিষ্টভাবে বসবাস, সুখ-দু:খ ও হাসি-কান্না, দৈহিক চাহিদা ভাগাভাগি করে নিতে দেয় এবং সন্তানদের উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে।

বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে এক মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যার কারণে তারা একই ছাদের নিচে জীবনের বাকী সময়টা পার করে দিতে পারে।

বিয়ে দুজন মানুষকে এক করলেও তা মূলত একটি সামাজিক স্বীকৃতি। সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার গঠনের স্বীকৃত পদ্ধতি বিয়ে। যে দেশ বা যে সমাজই হোক না কেন, প্রাচীন এ প্রথাই এখনো পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

একেক ধর্মে একেকভাবে বিয়ের নিয়ম রয়েছে। প্রধান ৪ ধর্মের বিবাহের নিয়মকানুন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

মুসলিম ধর্ম

ফার্মগেইট কাজী অফিসের কাজী আলহাজ্ব মাওলানা আবু বকর চাখারি মুসলিম বিয়ের আচার সম্পর্কে বলেন, “ন্যূনতম ৩ জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হয়। বিয়েতে দেনমোহর ধার্য করা হয় ছেলের আর্থিক সামর্থ্য ও অবস্থান অনুযায়ী।”

বিয়ের সময় একজন উকিল থাকেন। তিনি কনে পক্ষ অথবা ছেলে পক্ষের হতে পারেন। তবে সাধারণত কনে পক্ষ থেকেই উকিল থাকে। উকিল প্রথমে কনেকে জিজ্ঞাসা করেন বিয়েতে রাজি আছে কি না? কনে রাজি থাকলে বরকে তা বলা হয়। এরপর দোয়া কালাম করে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়।

আবু বকর চাখারি আরও বলেন, “ইজাব এবং কবুল এই দু’টিই আসলে বিয়ের মূল উপকরণ। হিল্লা বিয়ের ধর্মীয় ভিত্তি নেই।”

চাখারি জানান— আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রজ্ঞাপন ২০১১ অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্টারের জন্য ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার টাকা বা এর অংশ বিশেষের জন্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে কাজিকে নিবন্ধন ফি দিতে হয়।

দেনমোহর ৪ লক্ষ টাকার অধিক হলে পরবর্তী প্রতি ১ লক্ষ টাকা বা এর অংশ বিশেষের জন্য ১০০ টাকা বিয়ে নিবন্ধন ফি হিসেবে দিতে হয়। তবে দেন মোহরের পরিমাণ যাই হোক না কেনো সর্বনিম্ন নিবন্ধন ফি ২০০ টাকা।

হিন্দু ধর্ম

 আবহমান কাল থেকে সনাতন ধর্মীয় বিয়ের রীতিনীতি চলে আসছে । হিন্দু বিয়ে বেশ কয়েকটি আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সনাতন ধর্মীয় বিয়ে নিয়ে বিস্তারিত জানান, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত বিনয় কুমার গোস্বামী।

প্রথমত পাত্র-পাত্রীর সম্মতিতে একে অপরকে পছন্দের ভিত্তিতে অভিভাবকরা পঞ্জিকা থেকে শুভ দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন। বিয়ের ক্ষেত্রে শুভ দিনক্ষণ বলতে পঞ্জিকায় বিয়ের যে দিন উল্লেখ থাকে তাকেই বোঝায়।

বিয়ের দিন ঠিক করার অর্থ হল পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীকে বাগদান করা। আর বাগদান করা মানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করা।

বাগদান অনুষ্ঠানে পাটিপত্র করা হয়। এই পাটিপত্র উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে পুরোহিত লেখেন। পাটিপত্রে বর-কনের স্বাক্ষর থাকে। এরপর কোনো পক্ষের অসম্মতি প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না।

সাধারণত আশির্বাদ আসরে পাটিপত্র করা হয়। তবে অনেকে পাটিপত্র করে না। এরপর আসে আশির্বাদ আসর। এর প্রধান উপকরণ ধান, দূর্বা, প্রদীপ, চন্দন, পান, সুপারি ও বড় মাছ। পঞ্জিকা অনুসারে শুভদিন দেখে আশির্বাদ করা হয়।

বরপক্ষ কনেকে এবং কনেপক্ষ বরকে আশির্বাদ করে। আশির্বাদে অনেকে উপঢৌকনও দিয়ে থাকেন। বর-কনের দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয়, সেই প্রার্থনাই করা হয় আশির্বাদ অনুষ্ঠানে।

আশির্বাদের পর আসে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্যও দিনক্ষণ আছে। এখানেও শুভ দিনক্ষণ দেখে গায়ে হলুদের জন্য হলুদ কোটা হয়। ৫ বা ৭ জন সধবা স্ত্রীলোক মিলে হলুদ কোটে। এই হলুদই পরে গায়ে হলুদের দিন গায়ে মাখানো হয়।

গায়ে হলুদের পর এবার বিয়ের অনুষ্ঠান। দুই পর্বের অনুষ্ঠানে একটি ‘সাজ বিয়ে’ অন্যটি ‘বাসি বিয়ে’। দুটি আসরই কনের বাড়িতে বসে। তবে কোনো কোনো সময় বাসি বিয়ে বরের বাড়িতেও হয়ে থাকে।

‘সাজ বিয়ে’ বিয়ের মূল পর্ব। এই পর্বেই কনে আর বরকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করে বরণ করে নেয়। বরণ শেষে বর-কনে দুজনের দিকে শুভ দৃষ্টি দেয়, একই সময় মালা বদল করা হয়। পরে পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করে বর-কনের ডান হাত একত্রে করে কুশ দিয়ে বেধে দেন।

এরপর ‘বাসি বিয়ে’র পর্ব । বাসি বিয়েতে বিভিন্ন দেবদেবীর অর্চনা শেষে বর, কনের কপালে সিঁদুর দিয়ে দেয়। তারপর উভয় মিলে ৭ বার অগ্নি দেবতা প্রদক্ষিণ করেন।

এভাবেই বিয়ের আসরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

খ্রিস্টান ধর্ম-

বাংলাদেশে খ্রিস্টীয় বিয়েতে দেশীয় রীতি, কৃষ্টি ও সামাজিক মূল্যবোধ উপলব্ধি করে লোকাচার ও স্ত্রী আচার মিলে একটি নান্দনিক, আনন্দময় ও সুন্দর রূপ দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টীয় বিয়ে নিয়ে বিস্তারিত জানান, তেঁজগাও গীর্জার জুডিশিয়াল ভিকার ফাদার মিন্টু লরেন্স পালমা।

কনে নির্বাচন : খ্রিস্টান সমাজে সাধারণত প্রথমে পাত্রী দেখা হয়। প্রথমত বরপক্ষই কনে নির্বাচন করে। বরপক্ষ কনে নির্বাচন করে কনের চরিত্র, দোষ-গুণ, বংশ পরিচয় জেনে নেয়।

প্রস্তাব : শুভদিন দেখে বরপক্ষ কনের বাড়ি যায়। সাধারণত পাশের কোনো আত্নীয়ের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কনের বাড়ি যায় এবং তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানায়।

বাগদান : বরপক্ষের প্রস্তাবে কনেপক্ষ রাজি হলে বাগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও এ অনুষ্ঠানকে ‘পাকা দেখা’ও বলে। ভাওয়ালে এ অনুষ্ঠানকে ‘পানগাছ’ অনুষ্ঠান বলে। বাগদান উপলক্ষে পান, সুপারি, বিজোড় সংখ্যক মাছ নিয়ে যাওয়া হয়।

বাইয়র : এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষের লোকজন কনের বাড়িতে যায়। যা আগেই কথা বলে ঠিক করে রাখা হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত বর-কনে সবার আশির্বাদ গ্রহণ করে।

নাম লেখা : বিয়ের ৩ সপ্তাহ আগে কনের বাড়িতে পুরোহিতের কাছে বর-কনে নাম লেখান। অনেকে এ অনুষ্ঠানে আতসবাজি ও বাজনার আয়োজন করে।

বান প্রকাশ : এই অনুষ্ঠানে বর-কনে বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। মন্ডলীর বিধি অনুযায়ী এ সময় বিয়ের ক্লাস করতে হয়। এটি বিয়ে পূর্ব ব্যাধতামূলক ক্লাস ব্যবস্থা।

অপদেবতার নজর : নাম লেখা থেকে শুরু করে বিয়ের আগ পর্যন্ত বর-কনেকে অতি সংযমী জীবন করতে হয়। অনেকে এ সময় ভূত-প্রেত ও অপশক্তির নজর থেকে রক্ষার জন্য ‘রোজারি মালা’ বা ‘জপমালা’ গলায় পরেন।

কামানি বা গা-ধোয়ানী : বিয়ের আগের রাতের অনুষ্ঠানকে গা-ধোয়ানী বলে। অনেক খ্রিস্টান সমাজে এই দিন গায়ে হলুদ মাখিয়ে জাকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠান করা হয়।

কনে তোলা : বিয়ের দিন ভোরে বাদকদলসহ বরের আত্মীয়-স্বজন কনের বাড়ি গিয়ে কনেকে নিয়ে আসে। কনেকে ঘর থেকে আনার সময় তার হাতে পয়সা দেওয়া হয়। কনে বাড়ি থেকে আসার সময় সেই পয়সা ঘরের মধ্যে ছুড়ে ফেলে। এর অর্থ হল যদিও সে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, তারপরও বাড়ির লক্ষী ঘর থেকে চলে যাচ্ছে না।

গির্জার অনুষ্ঠান : শুরুতে গির্জার প্রবেশ পথে যাজক বর-কনেকে বরণ করে নেয়। তারপর বর-কনে দুজনের মধ্যে মালা বদল করা হয়। এরপর কনের সিঁথিতে সিদুর পরিয়ে দেওয়া হয়।

ঘরে তোলা : এই অনুষ্ঠানে উঠানের দিকে মুখ করে বড় পিঁড়ির উপরে বর-কনেকে দাঁড় করানো হয়। এরপর বর-কনে সাদা-লাল পেড়ে শাড়ির উপর দিয়ে হেঁটে ঘরে ওঠে। এ সময় বর ও কনে একে অপরের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে থাকে।

বৌদ্ধ ধর্ম-

বাংলাদেশে বৌদ্ধ বিয়ে লোকাচার ও বৌদ্ধ শাত্র অনুসারে হয়। বৌদ্ধ বিয়ে সম্পর্কে জানান, মেরুল-বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের প্রধান ধর্মগুরু ধর্ম মিত্র মাহাথেরো।

প্রথমত পাত্র পাত্রী নির্বাচনের পর সামাজিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তারিখ ঠিক করে বৌদ্ধ বিহারে পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে আসা হয়। এখানে মঙ্গল প্রদিপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের পুজা করা হয়। ত্রি স্বরণ পঞ্চশীল পুজার মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের আশির্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়।

এরপর একজন গৃহী তাদের সামাজিক অনুশাসন প্রদান করে।

বিশেষ বিবাহ আইন

তানজিম জানান, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে ১৮৭২ সালের বিশেষ বিয়ে আইন রয়েছে।

এই আইন অনুযায়ী বিশেষ বিয়ের জন্য একজন রেজিস্টার থাকে। প্রথমত বৈধ বিয়ে করা হচ্ছে এই হিসেবে এফিডেভিট করতে হয়, পরে রেজিস্টারের কাছে হলফনামা জমা দেয়। এর ১৪ দিন পর একটি নোটিশ দেওয়া হয়। পরে নোটিশ নিয়ে রেজিস্টারের কাছে গেলে বিয়ে নিবন্ধিত করা হয়।

‘কোর্ট ম্যারেজ’ মানেই বিয়ে নয়

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম জানান, আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজ’ বলে কোনো বিধান নেই এবং এর কোনো ভিত্তিও নেই। এটি একটি লোকমুখে প্রচলিত শব্দ।

তিনি আরও জানান, ‘কোর্ট ম্যারেজ’ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণা দেওয়াকেই বোঝান হয়ে থাকে। এ হলফনামাটি ২০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।

এ হলফনামাটি সম্পন্ন করলেই আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে, এটি বলা যাবে না। এটি বিয়ের ঘোষণামাত্র। অর্থাৎ এ হলফনামার মাধ্যমে বর-কনে নিজেদের মধ্যে আইন অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে, এ মর্মে ঘোষণা দেয়।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক আইন অনুযায়ী প্রথমে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। তারপর তারা ইচ্ছা করলে এ হলফনামা করে রাখতে পারেন। পারিবারিক আইন অনুযায়ি বিয়ে না করে শুধু এ হলফনামা সম্পন্ন করা উচিত নয়। সংগৃহীত

Bootstrap Image Preview