Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২১ মঙ্গলবার, জানুয়ারী ২০২৫ | ৮ মাঘ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মাথাপিছু জিডিপির শুভংকরের ফাঁকি, হাসিনার উন্নয়নের গলাবাজি

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৪ PM
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৪ PM

bdmorning Image Preview


ড. মইনুল ইসলাম।। অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে ৪৫ বছর ধরে আমি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে মাথাপিছু জিডিপির মারাত্মক সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো আমার মাস্টার্সের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এখন বক্ষ্যমাণ কলামে পাঠকদের বিষয়টি আবারও ব্যাখ্যা করছি, কারণ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে।

মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক অবস্থানের দরিদ্র জনগণের আয়ের বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে লুকিয়ে ফেলে। এর মানে, একজন কোটিপতির আয়ের সঙ্গে একজন ফকিরের শূন্য আয়ের গড় করলেও ওই ফকিরের মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ টাকা হয়ে যাবে। মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের কয়েক হাজার উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। 

বাংলাদেশের গত সাড়ে ১৫ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল একচেটিয়াভাবে পুঞ্জীভূত হয়ে গেছে কয়েক হাজার কোটিপতি ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে, যার কারণে বাংলাদেশ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছিল বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছিল বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ডলারের বেশি (প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা) নিট-সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের ‘আল্ট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ ইনডিভিজুয়াল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য-পরিমাপক জিনি সহগ, যা ১৯৭৩ সালে ছিল ০.৩৬, সেটা বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে পর্বতপ্রমাণ ০.৪৯৯-এ পৌঁছে গিয়েছিল। কোনো দেশের জিনি সহগের মান ০.৫ হলে সে দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ বলা হয়। অতএব, নিঃসন্দেহে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের’ দেশে পরিণত হয়েছে। 

সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বিপজ্জনক হওয়ার বিষয়টার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতা-পিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়ে গেছে; ৪) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫) দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়েল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৬) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৭) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী; ৮) দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা গড়ে তোলার হিড়িক চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। 

তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: (ভোগব্যয়+বিনিয়োগ ব্যয়+সরকারি ব্যয়+রপ্তানি আয়-আমদানি ব্যয়)। বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ ব্যয় এক দশক ধরে জিডিপির অনুপাত হিসেবে ২৩-২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু সরকারি খাতে অজস্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারি রাজস্ব আহরণ এ দেশে কমতে কমতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতিবছর সরকারি ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। ঋণ বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ালে তা জিডিপিকে বাড়িয়ে দেয়, সরকারি ঋণ বাড়লে জিডিপি কমে না। হাসিনা তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে।

৭ আগস্ট ২০২৪ দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ-প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যা ছিল ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও ভয়ানক প্রতারণা। ২০২৪ সালে প্রত্যেক বাংলাদেশির ঋণের বোঝা এক লাখ টাকার বেশি।

হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

দেশের এমন একটি প্রকল্পের নাম করা যাবে না যেটার খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ছাড়া কম নয়। এভাবে লুটপাটের অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে হাসিনা বিশ্বের নিকৃষ্টতম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ গড়ে তুলেছিলেন। গত সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুণ্ঠনের মহোৎসব-কাল। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দুঃখজনকভাবে হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।

সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছিল, কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি-লুণ্ঠন শাসক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বৈরাচারী হাসিনা ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেলেন, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সরকারের উন্নয়নের গলাবাজি। 

মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় মাথাপিছু জিডিপি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘ডাটা ডক্টরিং’-এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে ওই সময় থেকে ‘ডাটা ডক্টরিং’-এর সহায়তায় মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখানো এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো পরিকল্পনা ব্যুরোর খাসলতে পরিণত হয়েছিল।

পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে এহেন ‘ম্যানুফেকচারড’ তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। অতএব সবার জানা প্রয়োজন, এক দশক ধরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনি প্রচার করে হাসিনার সরকার দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন।

ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Bootstrap Image Preview