অনসূয়া বসু রায় চৌধুরী ও প্রার্থনা সেন।। কভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর এটিই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফর। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে এ সফরকে আরো বিশেষ করে তুলেছে।
আজ মঙ্গলবার দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার আগে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। বাণিজ্য, সড়ক অবকাঠামো, পানি ভাগাভাগি এবং জ্বালানি সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো শীর্ষ আলোচনায় প্রাধান্য পাবে।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতিপথ দেখলে বোঝা যায়, কিভাবে মোদি সরকার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ গুরুত্বের বিষয় হয়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের বিরোধীরা ক্রমাগতভাবে এ সম্পর্ক পর্যালোচনা করছে। যেমন : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রায়ই সমালোচনা করে যে ভারতের সঙ্গে আলোচনা বা মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ ‘খুব দুর্বল’ বা নতজানু নীতি নেয়। তাই ভারতে শেখ হাসিনার এই সফর দেশে আওয়ামী লীগের জন্যও বড় প্রভাব বয়ে আনবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
সংযোগ শক্তিশালী করা : সড়ক অবকাঠামো ও বাণিজ্য
শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ‘স্বাধীনতা সড়ক’ (২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক) উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার সঙ্গে সংযোগকারী এই ঐতিহাসিক সড়কের প্রস্তাবিত নামটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সড়কটির গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্মরণে রাখা হয়।
একটি সাধারণ ঐতিহ্য ভাগ করে নেওয়ার পর বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীরা অতীতের গৌরব পুনরুজ্জীবিত করতে এবং তাদের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে ঐতিহাসিক সংযোগগুলো আবার চালু করার ওপর জোর দেয়। পাঁচটি ঐতিহাসিক রেল সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি স্বাধীনতা সড়ক দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক। আসলে দুই দেশের বন্ধন কৌশলগত স্বার্থকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাণিজ্য খাতে তাকালে দেখা যায়, শেখ হাসিনার এই সফরে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (সেপা) চূড়ান্ত করতে আলোচনা শুরুর নির্দেশনা দেওয়ার জোরালো সম্ভাবনা আছে। সেপা স্বাক্ষরের ফলে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই লাভবান হবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর চুক্তিটি দুই দেশকে তাদের বাণিজ্য সম্পর্কের সব সুবিধা বজায় রাখতে এবং সুরক্ষিত করতে সক্ষম করে তুলবে। ফলে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি সম্ভাব্য যুগান্তকারী চুক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। (বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সেপাকে সতর্কভাবে দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন। )
পানি ভাগাভাগিতে বোঝাপড়া
শেখ হাসিনার সফরের প্রাক্কালে মুহুরি, গোমতী, খোয়াই, দুধকুমার, মনু, ধরলা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য ২৫ আগস্ট নয়াদিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ৩৮তম বৈঠক হয়। বন্যার তথ্য বিনিময় এবং নদীদূষণের ঝুঁকি মোকাবেলার মতো দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোও বৈঠকে আলোচিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, জেআরসির সুপারিশ অনুযায়ী দুই প্রধানমন্ত্রী পানিবণ্টনব্যবস্থা চূড়ান্ত করবেন।
উভয় পক্ষ কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়াও চূড়ান্ত করেছে। তাই দুই নেতার মধ্যে কুশিয়ারা পানিবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই নদী ভারতের নাগাল্যান্ডে সৃষ্টি হওয়ার পর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মণিপুর, মিজোরাম ও আসাম রাজ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদী ভারতের জাতীয় জলপথ-১৬-এরও (এনডাব্লিউ ১৬) একটি অংশ।
ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটের মাধ্যমে উপকূলীয় শহর কলকাতার সঙ্গে স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সংযুক্ত করতে জলপথটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাগাল্যান্ড এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য মণিপুর ও আসামের মধ্য দিয়ে জলপথ কুশিয়ারা ও সুরমা নদীতে গড়িয়েছে। এরপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নদীগুলো তাদের মিলনস্থলে মেঘনা নদীতে পরিণত হয়েছে। অভিন্ন এই নদীর জন্য পানিবণ্টনব্যবস্থা এ সফরে চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি এ ধরনের আরো ভাগাভাগির জন্য একটি সূচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যেকোনো সম্ভাব্য বিড়ম্বনা দূর করতে দুই দেশকে অবশ্যই তাদের সীমানা পেরিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর জন্য পানিবণ্টনের ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় যে তিস্তা চুক্তি সমাধানের পরিকল্পনা আপাতত পিছিয়েই থাকছে। বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করতে এই অনির্দিষ্টকাল ধরে দেরির কারণ হিসেবে মোদি সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
আন্ত সীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা
মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের একটি ইউনিটের কাজ শেষ করার ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্প ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে জ্বালানি নিরাপত্তার উদীয়মান উদ্যোগকে শক্তিশালী করবে। বাণিজ্য, সংযোগ ও পানিবণ্টনের বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলোর বাইরে জ্বালানি খাতে সহযোগিতা ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করতে এসেছে।
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই উদ্যোগ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ভারতের রাষ্ট্রচালিত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) মধ্যে একটি ৫০-৫০ যৌথ উদ্যোগের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
শেষ কথা
ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কগুলো থেকে শুরু করে অভিন্ন স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে কাজ করা পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতা ও শ্রদ্ধার প্রধান মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীরা বাণিজ্য, সংযোগ, শক্তি ও পানি ভাগাভাগির অপরিহার্য খাতে তাদের সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এর মাধ্যমে উভয় দেশের নেতারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সুবর্ণ পর্ব হিসেবে এই পর্যায়কে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন।
প্রকৃতপক্ষে কভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে এই সুবর্ণ পর্বে আরেকটি মাইলফলক হিসেবে দেখা যেতে পারে। তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার এই সফর বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারবে কি না—এই প্রশ্ন সামনের দিনগুলোতে জোরালো হবে।
লেখক : অনসূয়া বসু রায় চৌধুরী, নয়াদিল্লিভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) ‘নেইবারহুড ইনিশিয়েটিভের’ সিনিয়র ফেলো। প্রার্থনা সেন, ওআরএফ কলকাতার সাবেক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট