Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১২ শনিবার, অক্টোবার ২০২৪ | ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

এ অপমান সবার

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২২, ০৬:২৭ PM
আপডেট: ২৭ জুন ২০২২, ০৬:২৭ PM

bdmorning Image Preview


জোবাইদা নাসরীন।। আমাদের বড় বড় দৃশ্যমান অর্জন আড়ালে-আবডালে ঘটে যাওয়া গভীর ক্ষতগুলোকে কেমন করে যেন মুছে দিতে সহায়তা করে। পদ্মা সেতুর গৌরবে যখন আমরা আত্মবিশ্বাস এবং দেশপ্রেমের স্বস্তির ঢেঁকুর তুলছি তখন এ দেশে পদ্মা সেতুর ওপারের একটি জেলা নড়াইলে স্বপন কুমার বিশ্বাস নাম একজন শিক্ষকের গলায় ঝুলছিল জুতার মালা। এ খবরটি সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। এর পেছনে হয়তো নানা জানা-অজানা কারণ রয়েছে। এ দেশে এগুলো এখন অনেকটাই সহনীয় ঘটনা। কিছু দিন আগেই ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত আনার অভিযোগে জেল খেটেছেন হৃদয় মণ্ডল, পরে তিনি জামিন লাভ করেন। একই ‘অপরাধে’ শিক্ষকদের কানে ধরে ওঠ-বস করানোর ঘটনা স্মৃতি রয়ে গেছে।

যে দুই একটি গণমাধ্যমে সংবাদটি এসেছে সেখানকার তথ্য অনুযায়ী নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক ছাত্রকে যখন সবাই মারছিল তখন শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর কক্ষে ছাত্রটিকে আশ্রয় দিয়ে প্রাণে বাঁচাতে সহায়তা করেছেন। শিক্ষকের অপরাধ হলো– ছাত্রকে বাঁচাতে পুলিশকে খবর দিয়েছেন। আর সেই ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস। তাই সেই অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের ঘাড়েও দেওয়া হয়েছে এবং এটি সহজেই দেওয়া গেছে। কারণ, তারা দুই ছাত্র শিক্ষকই সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে।

একজন শিক্ষার্থী যখন আক্রান্ত হয় এবং শিক্ষকের সামনে এসে পড়ে তখন তার দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাকে রক্ষা করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা বহু সময় এমনও দেখেছি, মারামারির সময় শিক্ষার্থীরা দৌড়ে এসে শিক্ষকদের জাপটে ধরে বলেছেন, ‘স্যার আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে মারতে আসছে’। সেই ছাত্র হয়তো সেই শিক্ষকের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্ন তরিকায় বসবাস করেন, সেই শিক্ষক কিন্তু ছাত্রের নিরাপত্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এটাই শিক্ষকের কাজ। শিক্ষার্থীদের রক্ষায় সর্বোচ্চ করা। এ দায়িত্বটুকুই পালন করেছেন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। তিনি পুলিশি সহায়তা চেয়েছেন, সবই তার শিক্ষার্থীকে রক্ষা করার জন্য করেছেন।

এরপরের ঘটনা ভয়াবহ হৃদয় নিংড়ানো। গোনা কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অধ্যক্ষের গলায় ঝুলছে জুতার মালা। তার পাশে সেই ছাত্রের গলায়ও জুতার মালা। আর যারা এই কাজটি করেছে তারা অনেকেই এই শিক্ষকেরই ছাত্র। তাকে জুতার মালা পরিয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে।  সেই অধ্যক্ষ গলায় জুতার মালা পরে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন।  ক্ষমা চেয়েছেন যিনি যাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেই ছাত্রদের কাছেই।  তিনি তার আরেক শিক্ষার্থীর জীবন বাঁচাতে পদক্ষেপ নেওয়াতে অন্যদের ‘অনুভূতি’তে লেগেছে। তবে আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা এবং ওনার পাশেই আছেন পুলিশ। কীভাবে পুলিশের সামনেই এই ধরনের ঘটনা ঘটলো? যেহেতু পুলিশ সেখানে ছিল, তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ভালোভাবেই অবস্থা তদারকি করছিলেন। তাহলে এভাবে প্রশাসনিকভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হয়?

একজন শিক্ষক হিসেবেই শুধু নয়, একজন মানুষ হিসেবেও এই ঘটনা আমাদের লজ্জিত করে, মাথা নিচু করায়। শুধু শিক্ষকরা কাউকে মারলে রাস্তার সাধারণ অনেক মানুষও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। সেখানে অধ্যক্ষ তার মানুষ হিসেবে এবং শিক্ষক হিসেবে যা করণীয় সেটিই করার চেষ্টা করেছেন। এখন তিনি উল্টো অসম্মানিত হয়েছেন, হেয় হয়েছেন এবং সারা জীবনের জন্য অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

সাংবাদিকরা বলছেন– তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে চাননি। এরকম অপমানের পর কার সঙ্গে কথা বলবেন? প্রশাসনিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই ধরনের ঘটনা ঘটার পর কার কাছে বলার আছে? কেন কথা বলবেন? কী কথা বলবেন? বললে কী হতো?

এই কথাগুলোর যে আসলে কোনও ধরনের অর্থ নেই তা আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি। কারণ, এর যদি কোনও শক্তি থাকতো তাহলে হয়তো এ ধরনের ঘটনাই আমাদের চোখের সামনে ঘটতো না।

আমরা আরও জেনেছি অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস আতঙ্কে আছেন। থাকাটাই স্বাভাবিক। অসম্মান, অপমান এবং এ দেশে এরপর আর কী কী হবে সেগুলো হয়তো তিনি বুঝে গেছেন। পুলিশ প্রশাসন বলছে তিনি কোনও  নিরাপত্তাহীনতার কথা তাদের জানাননি। যে পুলিশের সামনে তাকে জুতার মালা গলায় দেওয়া হলো সেই পুলিশ প্রশাসনের কাছেই তিনি নিরাপত্তা চাইবেন? এও আমরা মানাতে চাই?  শুধু অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসই নয়, সবাই হয়তো জানেন এরপর কী হবে?

আমরা আরও জেনে গেছি অনেক কিছু। আমরা দেখেছি ২০১৬ সালে কীভাবে নারায়ণগঞ্জের কল্যান্দি এলাকার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে সেখানকার সংসদ সদস্য কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছিলেন। সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনরোষ উঠলেও সে ঘটনায় কোনও ধরনের বিচার বা শাস্তি হয়নি। অল্প কিছু দিন আগেই আরেক শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকেও নানাভাবে হেনস্তা করে, তাকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। তিনি ফিরে যেতে পেরেছেন শ্রেণিকক্ষে।

এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? একবারেই নয়। এ দেশে আমরা নিত্যদিন যে সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ করছি, এটি তারই ফল। এসবই হওয়ার কথা। তাই এখন আর এগুলোতে আমরা নজর দিই না।

শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অসম্মান ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তি যেমন দাবি করছি, তেমনি শিক্ষকরা এই অসম্মানের প্রতিবাদ করবেন বলেই বিশ্বাস করতে চাই। দালানকোঠার উন্নয়ন দিয়ে কী হবে যদি মান-সম্মান-বিশ্বাস-শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গাটিতে চিড় ধরে?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

(লেখাটি বাংলা ট্রিবিউন থেকে সংগৃহীত )

Bootstrap Image Preview