ব্যারিস্টার আতিক রহমান ।। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা। সম্প্রতি সেখানে কী ঘটে গেল শ্রীলঙ্কায় এ যে ভাবা যায় না। এমনটি কি কেউ কখনো কল্পনা করেছে! সে দেশের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ফলে সোশ্যাল আনরেস্ট অবশেষে গণ-অভ্যুথান।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার ক্ষমতাচ্যুত। রাজাপক্ষে তাঁর পরিবার ও দলবল নিয়ে পালিয়ে সে দেশেরই একটা আর্মি নেভাল বেজে প্রাণ বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছেন। এই গণ-অভ্যুত্থানে বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তার মধ্যে রাজাপক্ষের মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপিও আছেন, যাঁরা জনরোষের কবলে পড়ে গণপিটুনিতে মারা গেছেন। বড়ই হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য। দেশি-বিদেশি টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এসব সংবাদ।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই শ্রীলঙ্কা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। দেশটির মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১৪ হাজার মার্কিন ডলার; যা দক্ষিণ এশিয়া এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। শ্রীলঙ্কার শিক্ষিতের হার ৯২ শতাংশ, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ, শুধু জাপান বাদে। শ্রীলঙ্কা একটি দ্বীপ রাষ্ট্র, যা ভ্রমণের জন্যও বিশ্ববাসীর কাছে ‘লোনলি প্ল্যানেট’ হিসেবে সমাদৃত। শ্রীলঙ্কাও জাতিসংঘের মিলেনিয়াম গোলের প্রায় সব গোল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। শিশুমৃত্যু হ্রাসসহ জাতিসংঘের সব মিলেনিয়াম গোল অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও শ্রীলঙ্কা প্রথমসারির একটি দেশ; তিন-তিনবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সেমিফাইনালে খেলেছে এবং ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ জিতেছে।
অথচ তার পরও শ্রীলঙ্কার আজ কি ন্যক্কারজনক অবস্থা। কিন্তু কেন? কেন এমন হলো? এটা খুবই যৌক্তিক একটি প্রশ্ন। এ ব্যাপারে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের লেখা ‘পোভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস’ শীর্ষক লেখার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। অমর্ত্য সেন তাঁর লেখায় দেখিয়ে দিয়েছেন সোশ্যাল আনরেস্ট এবং দুর্ভিক্ষ শুধু খাদ্যের অভাবেই হয় না; সোশ্যাল আনরেস্ট এবং দুর্ভিক্ষ খাদ্যের এবং সম্পদের অসম বণ্টন এবং সমাজের অসমতা (ইনইকুয়ালিটিজ) থেকেও হয়। মি. সেন তাঁর বইয়ে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে দিয়েছেন ১৯৪৩ বাংলাদেশে তথা তত্কালীন অবিভক্ত বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেটাও খাদ্য ঘাটতির জন্য হয়নি, হয়েছে সামাজিক অসামঞ্জস্যতার কারণে এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবে।
এ দেশ ছিল তখন ব্রিটিশের অধীন। শহরকেন্দ্রিক ইকোনমিক বুম বা অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল তখন। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মি. সেন তাঁর বইয়ে ডাটা দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন সে সময় বাংলাদেশে যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ ছিল। শুধু সাপ্লাই এবং সমাজের অসমতা (ইনইকুয়ালিটিজ) থেকে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল। খাদ্যশস্য মজুদ এবং সাপ্লাইটা ছিল একেক শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ; যেমন—মিলিটারি, সরকারের তল্পিবাহক, অলিগার্ক, পেনিক বায়ারস, প্রাইস গেজারস বা অতি মুনাফাখোরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যদ্রব্যসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত জিনিসপত্রের মূল্য হয়ে যায় আকাশচুম্বী। বাংলাদেশের ভূমিহীন কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, মুচিসহ নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে অসংখ্য মানুষ না খেয়ে মারা যায়। প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ১৯৪৩ সালের সেই দুর্ভিক্ষে মারা যায়, যা তেতাল্লিশের মন্বন্তর হিসেবেও আজও বাংলাদেশের মানুষের মনে গেঁথে আছে।
অমর্ত্য সেন সেই সত্যকে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে যে ‘গণতন্ত্র এবং রুল অব ল’ কতটা প্রয়োজনীয় একটা দেশ এবং জাতির জন্য। শুধু উন্নয়ন দিয়ে দেশ বা জাতি রক্ষা করা যায় না। শ্রীলঙ্কা এই সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। মাহিন্দা রাজাপক্ষে একটা পরিবারকেন্দ্রিক সরকার গঠন করে বহুদিন ধরে দেশ চালাচ্ছিলেন। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে অলিগার্ক এবং তারাই রাজাপক্ষে ও দেশটার বারোটা বাজিয়েছে। অমর্ত্য সেন একবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। তিনি দেখিয়েছেন অলিগার্করা কিভাবে একটা দেশের দারিদ্র্য, এমনকি দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত ঘটিয়ে দিতে পারে। আমরা আশা করব শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে সার্কভুক্ত সব দেশ ‘গণতন্ত্র এবং রুল অব ল’ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ও যত্নবান হবে।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সলিসিটর