বিরল হওয়ার কারণেই জিনগত রোগের চিকিৎসা আবিষ্কারে খুব বেশি বিনিয়োগ করছে না বিশ্বের বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। কিন্তু, আগেভাগে শনাক্তকরণ শুরু হলে অনেক রোগী শনাক্ত হবে। তখন ব্যবসার অমিত সম্ভাবনা বুঝেই গবেষণার পরিধি বাড়াবে ফার্মা জায়ান্টরা।
বিরল জেনেটিক ভারস্যাম্যহীনতা বা ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে অনেক শিশু । এই সমস্যাগুলো হতে পারে নানান রকম। যেমন তার থাকতে পারে- সিকল-সেল এনিমিয়া বা সিসস্টিক ফিব্রোসিস। প্রথমটির নাম কালেভদ্রে অনেকের শোনা থাকলেও, আরো বিরল অ্যাড্রেনোলিয়াকোলিস ট্রফি অথবা এহলারস ড্যানলোস সিনড্রোম সম্পর্কে জানাশোনা চিকিৎসা খাতের বাইরে অনেক কম।
এই সমস্যাগুলো নবজাত শিশুর ক্ষেত্রেও থাকতে পারে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই বাবা-মা হিসেবে সে সম্পর্কে আপনি কি জানতে চান না? জানতে চান না, এসব রোগের কার্যকর চিকিৎসা আছে কিনা?
সুযোগ পেলে বেশিরভাগ মা-বাবাই তা চাইবেন। তাছাড়া, এমন শিশুর যথাযথ চিকিৎসা না করানোর ফল হতে পারে মারাত্মক। কারণ অনেক পরে যদি জানতে পারেন, আপনার সন্তান আর মাত্র পাঁচ বা ১০ বছর বাঁচবে- তাহলে আকস্মিক দুঃসংবাদে ভেঙ্গেও পড়বেন। কিন্তু আগে থেকেই জানা থাকলে, সুচিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করা যেত। আগেভাগে জানা ও না জানার ব্যবধানটা এখানেই—জীবন ও মৃত্যুর।
তবে এক্ষেত্রে রয়েছে একটি বড় সমস্যা। এ পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি তাতে ভূমিষ্ঠ শিশুর জেনেটিক ত্রুটি সঙ্গে সঙ্গেই শনাক্ত করা যায় না। আসলে বয়স আরেকটু বাড়ার সাথে সাথে নানান লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। জেনেটিক রোগ বিরল হওয়াও শনাক্তে দেরির আরেকটি কারণ। বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক ও সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছাড়া প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করা বেশ কঠিন।
জিন-সিকোয়েন্সিং এর সুবিধা ও অপার সম্ভাবনা
প্রথম থেকেই সঠিক চিকিৎসা না দেওয়া হলে- রোগগুলি পরবর্তীতে আরো গুরুতর রূপ নিতে পারে। এতে যুগান্তকারী এক পরিবর্তন এবার হয়তো ঘটতে চলেছে। প্রথমবার মানব জিন বিশ্লেষণ করে এর মানচিত্র তৈরির পর কেটে গেছে ২০ বছর। প্রথমে বেশ ব্যয়বহুল থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ জিন-সিকোয়েন্সিং প্রক্রিয়ার খরচ এতটা কমেছে যে, অন্তত ধনী দেশের নবজাত শিশুদের ওপর এটি প্রয়োগ করা সম্ভব। নবজাতকদের ক্ষেত্রে এটি একটি রুটিন চেকআপ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।
আগেই বলা হয়েছে, আগেভাগে ডায়াগনোস্টিক করা গেলে- তা এনে দেয় প্রথম থেকে চিকিৎসার সুযোগ। যেমন জেনোম ডেটায় প্রকাশ পায় এডিএইচডি, বিষণ্ণতা বা ক্যানসারে আক্রান্ত কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট ওষুধগ্রহণ বেশি কার্যকর হবে। জিন মানচিত্র কারো জীবনযাপন কেমন হবে সে সম্পর্কেও ইঙ্গিত দিতে পারে। এতে করে- ক্যান্সার, ফুসফুসের নানান ব্যাধি ও হৃদরোগসহ একটু সচেতন হলে রোধ করা সম্ভব এমন অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানো যাবে। নেওয়া যায় কার্যকর এবং আরো জোরদার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
তাছাড়া, জীবিত মানুষের সাথে সামঞ্জস্য থাকা জেনোম ডেটাবেজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাকে গতিশীল করবে। যত সময় যাবে এসব গবেষণার ফলাফল জিনোম সিকোয়েন্স থাকা ব্যক্তিদের ততো বেশি উপকারে আসতে থাকবে।
নবজাতক শিশুর জেনোম ডেটা তাদের নানান বিরল রোগব্যাধির জন্য নতুন চিকিৎসা আবিষ্কারের সুযোগও সৃষ্টি করবে। পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার বিরল রোগ আছে বলে ধারণা করা হয়, যাতে আক্রান্ত প্রায় ৪০ কোটি মানুষ। এগুলোর বেশিরভাগই আবার জেনেটিক।
বিরল হওয়ার কারণেই এসব রোগের চিকিৎসা আবিষ্কারে খুব বেশি বিনিয়োগ করছে না বিশ্বের বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। কিন্তু, আগেভাগে শনাক্তকরণ শুরু হলে অনেক রোগী শনাক্ত হবে। তখন ব্যবসার সম্ভাবনা বুঝেই গবেষণার পরিধি বাড়াবে ফার্মা জায়ান্টরা।
ব্রিটেনে নবজাত শিশুদের জেনোম সিকোয়েন্সিং করার একটি বড় প্রকল্প আগামী বছর থেকে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের নানান সুবিধা-অসুবিধা পর্যবেক্ষণ করে পরে তা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও কাতারসহ ইউরোপের অনেক দেশের একই রকম উদ্যোগে প্রয়োগ করা হতে পারে।
এক্ষেত্রে প্রথমে বুঝেশুনে পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলোকেই ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেমন ব্রিটেনে অত্যন্ত সুপ্রমাণিত কিছু জিন টেস্ট দিয়েই প্রকল্পটি যাত্রা শুরু করবে, এতে শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে উন্নতি হওয়ার আশা করছেন ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, এতে জিন পরীক্ষা কেবল শিশুর কল্যাণেই যেন লাগে তা নিশ্চিত হবে। পরীক্ষার ফলে যেসব শিশুর জিনে ত্রুটি থাকার ঝুঁকি দেখা যাবে, তাদের ওপর আরো ডায়াগনোস্টিক করায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
উন্নত দেশে এসব পরীক্ষার আর্থিক দিকটি একে জাতীয় পর্যায়ে সকলের জন্য উপলদ্ধ করে তোলে কিনা—তাই এখন দেখার বিষয়। বর্তমানে এসব পরীক্ষার কারিগরি খরচের দিকটি অনেকটাই কম সেখানে। সে তুলনায় বেশিরভাগ অর্থ যায় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও ল্যাব কর্মীদের বেতনভাতায়। তবে যে দেশগুলো এসব বাধা কাটিয়ে নবজাতকদের জিন পরীক্ষা প্রথমদিকে শুরু করবে- তারা এগিয়ে থাকবে জেনোম বিপ্লবের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর দিক থেকে। ২০ বছর আগে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, আশা করা যায় খুব শিগগির তা চিকিৎসা খাতের দৈনন্দিন অংশ হয়ে উঠতে চলেছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে