সাক্ষাৎকারে আবুল মাল আবদুল মুহিত
ফয়সল আহমদ বাবলু।। কীর্তিমান রাজনীতিবিদ, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী, সফল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা-সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর দেশ গঠনের কাজেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কখনও প্রশাসনের কর্মকর্তা, আবার কখনও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে অনন্য অবদান রেখেছেন। রাষ্ট্রচিন্তক, কূটনীতিক ও প্রাজ্ঞ এই ব্যক্তি গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালের মুখোমুখি হয়েছিলেন। রাষ্ট্র-সমাজ, অর্থনীতি, সমাজনীতি- নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। ৮৮ বছর বয়সেও নিজের কাজ করার চেষ্টা করেন। কণ্ঠে জড়তা থাকলেও তার কথা বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না।
বিকেল ৪টার দিকে সিলেটের ধোপাদীঘিরপাড় হাফিজ কমপ্লেক্সে তার বাড়িতে যাওয়ার পর দেখা যায়- তিনি শুয়ে আছেন সোফায়। মাঝেমধ্যে তার দিকে খেয়াল রাখছেন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়া এবং ছাত্রলীগ নেতা জনি। তাকে দেখতে আসেন অনেক স্বজন। কেউ কেউ চুপি চুপি দেখে চলে যান। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার ঘুম ভাঙে। বাচ্চু মিয়া তাকে সোফায় বসান। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে জানতে চান, কেমন আছেন? তারপরই শুরু আলাপচারিতা। বাচ্চু মিয়া জানিয়ে দিলেন, তারা আপনার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। এরপরই হাসিমুখে বেশ কিছু সময় একান্তে কথা বলেন।
কেমন আছেন?- জানতে চাইলেই বলেন, আল্লাহতায়ালা অনেকটা ভালো রেখেছেন। ৮৮ বছর অনেক লম্বা সময়। এই সময়ে বেঁচে আছি, এটাও একটা বড় প্রাপ্তি। রোগ-শোক থাকবেই। তারপরও অনেকটা ভালো আছি। মন্ত্রী থাকাকালে সরকারের কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন- এমন প্রশ্নে বলেন, সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। শেখ হাসিনা আমার উন্নয়নের একটা বড় শক্তি। যে শাসন করে, তার সঙ্গে সম্পর্ক মধুর না হলে কাজ করা কঠিন। আমি সেদিক দিয়ে অনেকটা 'সাকসেসফুল'।
দেশের অর্থনীতি আপনার হাত ধরেই অনেকটা এগিয়ে গেছে, বর্তমান অর্থনীতি কেমন- জানতে চাইলে বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদের সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, এখন আর তখন। এই দুই সময়ের মধ্যে অনেকটা ফারাক আছে। আমি যে ধারাবাহিকতা রেখে এসেছি, তা ধরে রাখা গেলে তেমন বেগ পোহাতে হবে না। যদি না বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ সামনে এসে না দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার খোঁজখবর নেন কিনা- এমন প্রশ্নে বলেন, আগেই বলেছি, মধুর সম্পর্ক না হলে অনেক কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো না। তার সঙ্গে আমার অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক। তিনি সব সময় আমার শারীরিক খোঁজখবর নেন।
শুনেছিলাম, আপনি রাষ্ট্রপতি হবেন, এটি নিয়ে আপনার কোনো দুঃখ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার একটা মনোবাসনা ছিল। কিন্তু না হওয়াতে কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ নেই। সবকিছুই একটা নিয়মে হয়ে থাকে। আপনি সত্যিকার অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ- এমন কথা বলতেই মুচকি হেসে বলেন, আলোকিত করার চেষ্টা করেছি। আমার নির্বাচনী ইশতেহারেই ছিল 'আলোকিত সিলেট'। এখনকার সিলেট আর আগের সিলেট কেমন দেখছেন- এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে বলেন, সময় অনেক কিছু পরিবর্তন করে। শুধু সিলেট নয়, সারাদেশেই পরিবর্তন হয়েছে। আগে আমার চুল ছিল কালো, এখন সাদা হয়েছে- এটাই বাস্তবতা। তবে অনেক পরিবর্তন, এটি দেখে অনেকটা ভালো লাগে।
সিলেটের পর্যটন সম্ভাবনার বিষয়ে বলেন, আমাদের পর্যটন সম্ভাবনা অনেক ভালো। এই যে বিভিন্ন ধরনের পর্যটন সেন্টার হইছে লালাখাল, বিছনাকান্দি ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলাতে সিলেটিজ অ্যান্ড নন-সিলেটিজ অনেক মন্ত্রীর অবদান রয়েছে। মোটামুটিভাবে সিলেট 'ইজ এ বিউটিফুল টাউন'; ভালো পপুলেশন, শিক্ষিত পপুলেশন, আর উন্নত ক্লাসের মানুষজন উকিল-মোক্তার এইসব বেশি আছলা (ছিলেন) সিলেটে। সিলেটে লেখাপড়ায়ও অ্যাডভান্সড। নিজের পরিবার সম্পর্কে মুহিত বলেন, আমরা ১৪ জন ভাইবোন। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আমি এই দেশের বৃদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। এ বছরের জানুয়ারিতে আমার বয়স ৮৮ বছর হয়েছে। আমাকে দীর্ঘ জীবন দান করায় মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এক ছেলে দেশে আছে। আরেক ছেলে আমেরিকা থাকে।
নিজে থেকেই ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে গ্রামীণ জীবন থেকে শহর জীবনের নানা দিক তুলে ধরে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ছোটবেলার আনন্দময়, স্বাধীনতার দিনগুলো খুবই উপভোগ্য ছিল। সেইসব দিনের সুখকর স্মৃতির কথা এখনও মনে পড়ে। আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন অভিভাবক। তাদের কথা মনে পড়ে। সিলেটের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্প্রীতির ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান সিলেট। জন্মভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। সিলেটে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে হজরত শাহজালাল (রহ.) এসেছিলেন। আমরা বেশিরভাগ মানুষ তার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। ধর্মাচার পালন করেও আসছি। আমাদের এখানে অন্যান্য ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাও সমানভাবে পালিত হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য বহু পুরোনো।
করোনার সংক্রমণ ও অসুস্থতার কারণে প্রায় দুই বছর সিলেটে আসেননি আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় একটি ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান দলীয় নেতাকর্মীসহ অন্যরা। রাতেই পৈতৃক বাড়িতে ফেরেন সিলেট-১ আসনের সাবেক এই সাংসদ।
করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই গুণী এই ব্যক্তি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। গেল সপ্তাহে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নিজের শহর সিলেটের জন্য মন টানছিল। সিলেটে আসার পর থেকেই হাসিখুশি। রাতে ঘুরে দেখেন পুরো সিলেট। সিলেটের মানুষও দলবেঁধে তাকে দেখতে যান, সঙ্গ দেন। কেউ কেউ তার সঙ্গে সেলফিও তোলেন। গত বুধবার রাতে সিলেটের সুরমা নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী আলী আমজাদের ঘড়িঘরের সামনে তাকে গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা দেওয়া হয়। রাত ৮টায় তিনি অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলে সিলেট মহানগর পুলিশের বাদক দল তাকে অভ্যর্থনা জানায়। এরপর মঞ্চে মেয়র, কাউন্সিলরসহ সিসিকের কর্মকর্তারা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করেন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী স্মারক হিসেবে শতবর্ষী আলী আমজদের ঘড়ির স্বর্ণখচিত প্রতিকৃতি তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সংবর্ধনার জবাবে মুহিত বলেন, নিজের জন্মস্থানে এমন একটি সম্মাননা লাভ গৌরবের। আমি সিলেটের মানুষ। এটা একটা গর্বের বিষয়। মুহিত বলেন, সিলেটের পরিবেশেই আমার জন্ম। আমার বেড়ে ওঠা। আমি এখানে জন্ম হওয়ার কারণে গর্ববোধ করি। এখান থেকে অনেক গুণীর জন্ম হবে। আজকে সিলেট নগরে আমি একজন অতিথি। এটাও একটা গর্বের বিষয়।