আরিফ চৌধুরী শুভ।।
একজন মন্ত্রী কতটা দামী তা এই মুহুর্তে রাস্তার জনগনই টের পাচ্ছেন। একজন মন্ত্রীর হাসি কতটা ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক তাও কিছুদিন আগে টের পেয়েছে সংশ্লিষ্ট দল। তবুও রাজার কাছে তার গাধার মূল্যই লাখ টাকা। পরিবর্তন কিছু হয়নি, হবেও না। কারণ এই রাষ্ট্রে জীবনের চেয়ে ক্ষমতাই দামি। মানুষের জীবন কুকুরের চেয়েও মূল্যহীন এদের কাছে। এদেশে মানুষ মরলে বিচার হয় না, কিন্তু কুকুর মরলে জেল হয়, জরিমানাও হয়। কলুর বলদ মরলে কার ই বা কি আসে যায়। কারণ পরদিনতো মন্ত্রীরা দুধ দিয়ে গোসল করে জানাযায় অংশ নিবেন ২০ হাজার টাকার বান্ডিল হাতে। তখন আমরাও ভুলে যাবো কাঁদতে কাঁদতে। যেমন আমরা ভুলে যেতে বসেছি রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীদের বাস চাপা দিয়ে হত্যা করার ঘটনা। আমরা ভুলে গেছি রাজিবে ঘটনা।
আমরা ভুলার জাতি এভাবেই ভুলে যাই সড়কে ঝরেপড়া প্রতিটি জীবনের করুণ কথা। সড়কে পড়ে থাকা দেহ বিচ্ছিন্ন মানব মাথা আমাদের চোখে নয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে লজ্জায় ঘৃণায়। জনগণ আমরা তবুও লজ্জিত নই, প্রতিবাদী নই। বরং সম্ভ্রম হরণ করি প্রতিবাদকারীর। আমরা অধিকার কোনটা আর দায়িত্ব কোনটা তা ভুলে যাই স্বস্বার্থে। তাই সুবোধরা বার বার আসে না আমাদের মাঝে। কারণ যখন সুবোধ আসে ,তখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি অর্থহীনভাবে। তাই কালিটা আজ আমাদের মুখেই লাগলো এবং আরো লাগবে। এটা শুরু হলো মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন রাখলাম এটাই কি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ফসল? এটাই কি আগামীর বাংলাদেশ?
রাজনৈতিক নেতা আর জনগণের আত্মার স্পন্দনের মাঝে আজ পিতলের দেয়াল। না হলে স্কুল শিক্ষার্থী আর রোগীবাহী আ্যাম্বুলেন্সে কেন মবিল ঢালা হবে। এ যাবৎ কালে ছোট বড় কোন আন্দোলনেতো এইসব বাজে চিত্র দেখেনি বাংলাদেশ। পিতলের দেয়াল ক্রমেই ঘাড় হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যতই শক্তিশালী ও বিত্তবান হচ্ছে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে জনগণ। পাথরের দেয়াল ক্ষয় হয়, শোনা যায় ওপারের ক্রন্দন, উপলব্ধি করা যায় পরষ্পরের চাহিদা আর অনুভূতি, কিন্তু পিতলের দেয়াল কি কখনো ক্ষয় হয়?
জনগণের আত্মা বুঝার রাজনীতি আর জননেতা, দুটোই আজ বিপরীতমুখী গন্তব্যে চলমান আনন্দ বাজারের দুলর্ভ পণ্য। তবুও ক্রেতার খোঁজে নানা জনের এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গণসংযোগ। কে কোন দলে যাবেন বিচার আপনার; কিন্তু উন্নয়ন আর পিরিস্তির বয়ান শুনে আগুনে আত্মহুতি দেওয়া জনগণ কিন্তু কম নয়?
পরিবহনের অপেক্ষায় থাকা এই জনগণই দুদিন পরই সব ভুলে ভোট দিবে (যদি সুযোগ পায়) এইসব মন্ত্রীদের। যদিও এখন গালাগালি দিচ্ছেন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী জল-স্থল তল-উপতলের বহু শ্রমিকদের প্রাণের নেতা। কিন্তু যারা এরই মধ্যে বুজে গেছেন মন্ত্রীর অট্টহাসির কথা তারাও কি প্রাণের নেতা মনে করেন এখনো? তারই সংগঠনের শ্রমিকদের নিহত সন্তানের জন্য তার প্রাণ কাঁদে না, বরং তিনি হেসে উঠেন শরীরের পঞ্চইন্দ্রিয় নাড়িয়ে। তবুও কিভাব তিনি শ্রমিকদের কাছে প্রিয়। কি অবাক মানব অনুভূতি!
সংবাদে দেখলাম, শ্রমিকদের প্রাণের নেতাই জানেন না ৪৮ ঘন্টার পরিবহন ধর্মঘটের কথা, তাহলে অট্টহাসির মন্ত্রী কি করে জানবেন রাস্তায় রাস্তায় তাঁর ‘সৈনিকেরাদের’ দ্বারা চালক ও যাত্রীদের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে নির্যাতন করার কথা? যদিও জানেন তিনি কি আগের মতো আবারো দাঁত কেলিয়ে হাঁসবেন? টেলিভিশনে এই দৃশ্য দেখে মন্ত্রী হয়তো এতক্ষণে বার কয়েক হেসে হেসে আনন্দ অনুভব করলেন।
শিক্ষার্থীদের সড়কে নিরাপত্তা আন্দোলনে সম্মানে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করাকে যদি শান্তিপূর্ণ অবরোধ বলি, তাহলে যাত্রীদের মুখে কালি মাখানোকে আজ কি বলবো আমরা? জানি না সরকার ও সরকারের মন্ত্রীরা কিভাবে নিচ্ছেন এই বিষয়গুলো। কিন্তু এই কালি মাখা মুখগুলোই যে বাংলাদেশের সম্মান তা নিশ্চয় মন্ত্রীদের উপলব্ধিতে আসবে না। এই সম্মান খর্ব করার অধিকার তাদের কে দিলো? শাস্তি কি হবে?
পরিবহনের নিচে পড়া প্রতিটি প্রাণই অমূল্য, কিন্তু তার জন্যে চালকরা যতেষ্ঠ সচেতন নয় বলেই পরিবহন আইন সংশোধন করা হয়েছে। তাহলে কার স্বার্থ রক্ষার্থে এমন অদ্ভুত অবরোধ? শ্রমিকরা যদি আজ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, কর্তা হাঁটালে হাঁটতে হবে, কাঁদালে কাঁদতে হবে এমন আচরণ করতে থাকে, তাহলে সারাদেশে যেসকল অপৃতিকর ঘটনা ঘটবে এই দুইদিন, তার দায়ভার কিন্তু নেতাকেই নিতে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করা হলে তার জন্যে মামলা হওয়া উচিত এবং সেটি যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত।
লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এমন মন্ত্রীকে আমরা না দেখলেও ঠিকই ১৫-২০ জনের আন্দোলনে মন্ত্রী ও মন্ত্রীপুত্র হাজির হন হাসতে হাসতে। কালো গ্লাসের ভেতর দিয়ে এমন মন্ত্রীরেই আজ জনগণকে মাছি আর মশা দেখেন কিন্তু জনগণকে নিবৃত করার জন্যে, ভোগান্তিতে ফেলার জন্যে শ্রমিকদের দেখেন দাবার শেষ চালের সৈনিক হিসেবে। মেরে ও মরে হলেও তারা জয়ী হতে চায়। তাই তারা বার বারই জিন্মি করে মানুষকে। বাংলাদেশকে।
এই মুহুর্তে যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করেন, কেমন বাংলাদেশে আমি আছি? তাহলে আমি বলবো আপনি আজকে রাস্তায় বের হন। হতাশাগ্রস্ত, ভোগান্তির শিকার, আ্যাম্বুলেন্সে আটকা পড়া রোগীদের দেখুন, কর্মহীন উপোষ খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে দেখুন, গন্তব্যে পৌঁছার জন্যে নাক চেপে ময়লা পরিবহনের গাড়িতে উঠা যাত্রীদের দেখুন, স্কুল ড্রেসে পোড়া মোবিল লাগিয়ে দেওয়া শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করুন এই প্রশ্ন। এটাই আজকের সত্যিকারের বাংলাদেশ।
আজ আমাদের কোনো অধিকার থাকতেও নেই। ক্ষমতার এই ধু ধু প্রান্তরে ঘাসের মতো জনতাকে পায়ে মাড়িয়ে যাওয়া যায়, কাটা যায়, ছেঁড়া যায়, কিন্তু ক্ষমতার হুংকার দিয়ে ক্রিতদাশের হাসি কেনা যায় না। জনগণের ভালোবাসা পেতে হলে আপনাদের পিতলের মন ভাংতে হবে। জনগণের কাতারে আসতে হবে। যে ক্রিতদাসের ভালোবাসা আদায় করতে পারে, সেই প্রকৃত মনীব।
আইন-সংবিধান-নৈতিকতা এই শিক্ষাটাই বারবার আমরা পাচ্ছি রাষ্ট্রের কাছে, কিন্তু বিচার পাচ্ছি না।ক্ষমতাহীনের জন্য এই শিক্ষাটাও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় টিকে থাকার পরীক্ষাই আসল পরীক্ষা আমাদের।আমরা আছি বাঁচা লড়ায়ে, আর রাজনৈতিক নেতারা আছেন নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে। এই জীবনে এক কড়া শিক্ষাসফর আজকের রাজপথ। আমরা সেই শিক্ষা হাড়ে-মনে পাচ্ছি।
কথায় আছে, জোর যার মুলুক তার। জোর খাটিয়ে আজ আমাদের মধ্যে কিছু সময়ের জন্যে ভয়টা জাগিয়ে রাখাই যথেষ্ঠ, কিন্তু মিথ্যে রাখাল বালকের মতো ঠিকই ভয় নিজেদেরই একদিন গ্রাস করবে জনরোষের দাবানলে।
প্রশাসন আর দলীয় শক্তির কাছে জনগণকে যদি বলহীন ভাবা হয়, তাহলে অনেক বড় ভুল ভাবা হবে। সরকারের কাছে জাস্ট একটাই প্রশ্ন, ‘আমাদের কি চোখ নেই?
শেক্সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের শেষ সংলাপটির কথা নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে। সংলাপটি ছিল এমন, ‘তুমি যদি অন্যায় করো, আমি কি তার প্রতিশোধ নেব না? নাটকের সংলাপ যদি সত্যি হয়, তাহলে আজকের এই অন্যায়গুলোর প্রতিশোধ জনগণ ঠিকই একদিন নিবে। আজকে না হয় অারো একবার শয়ে গেলাম পোড়া শরীরে।
উদ্যোক্তা ও সংগঠক, নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন। শিক্ষার্থী, আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।