নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারাদেশের মানুষ সোচ্চার হওয়ার পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। দেশব্যাপী পরিবহন শ্রমিকদের দাপট চলছেই।পরিবহন ব্যবস্থায় এক ধরনের নৈরাজ্য অবস্থা চলছে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ইচ্ছামত ভাড়া নির্ধারণ, যাত্রীদের সাথে খারাপ আচারণতো আছেই। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এসবের বাইরে কতটা ভয়ংকর পর্যায়ে নেমে গেছে দেশের পরিবহন শ্রমিকরা। এদের দৌরাত্ম্যে আজ অসহায় যাত্রীরা। এদের বেপরোয়া চলাচলে প্রতিদিন প্রাণ দিতে হচ্ছে, অঙ্গ হারাতে হচ্ছে মানুষকে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী গত ৫৫০ দিনে ৪ হাজার ৯৮৩ জন মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ দিয়েছে। এই তথ্য আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে। প্রতিদিন মৃত্যুর এই মিছিলে যোগ হচ্ছে তাজা তাজা প্রাণ। অঙ্গহানির কাতারে সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিনই। কিন্তু এরপরও কী শৃঙ্খলা ফিরেছে পরিবহন সেবায়?
উত্তরটা নাই হবে। গতকাল সোমবার চট্টগ্রামে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার জেরে রেজাউল করিম রনি (৩২) নামে এক যুবককে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে বুকের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে হত্যার ঘটনা সেই বার্তা দিচ্ছে। গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে বাগবিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে যাত্রী বাস চাপায় হত্যা করার মতো নৈরাজ্য আমাদেরকে আতঙ্কিত করে।
এর আগে গত ২২ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার বদ্দরহাট এলাকায় শরীর ওপর দিয়ে ট্রাক উঠিয়ে আমানুল্লাহ নামে এক বেকারী কর্মীকে হত্যা করা হয়। তার অপরাধ ছিল শুধু ট্রাকটি ধাক্কা দেয়ার উপক্রম করায় তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে তার ওপর ট্রাক চাপিয়ে দেয় চালক।
তারও এক দিন আগে ২১ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েলকে আহত অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া হয়। পরে নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
পরে বাসটির চালক হেলপারদের আটকদের পর জানা যায়, পথিমধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নিচে নামেন পায়েল। এসময় বাসটি দ্রুত টান দিলে পায়েল বাসের দরজার সঙ্গে জোরে ধাক্কা খান। ফলে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। গুরুতর অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন পায়েল। তখন মারা গেছেন ভেবে ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেয় বাসের হেলপার ও সুপারভাইজার।
এর দুইদিন পর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় পায়েলকে উদ্ধার না করে তাকে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় কতটা ভয়ংকার হয়ে উঠেছে এসব পরিবহন শ্রমিকরা।
রাস্তায় উঠেলে এখন জীবনটা যেন হাতে নিয়ে বের হতে হয়। প্রিয় মানুষগুলোকে বাড়িতে দেখে এসে আবার বাড়ি ফিরে তাদের হাসিমাখা মুখ দেখতে পারবো এই নিশ্চয়তা আজ আর দেয়া যায় না। প্রতিটি বাস যেন কারো বাবা, মা, সন্তানদের হত্যার দাগ বহন করছে। বাসগুলো থেকে যেন এখন ধর্ষিতার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এর এসবই করে যাচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরা। আইন মানবিকতার তোয়াক্কা না করেই হিংস্র হয়ে উঠেছে এরা।
আমরা আরও বেশি আতঙ্কিত হয় যখন খোদ পরিবহনর মালিকদের সংগঠনের নেতা যখন বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর শতকরা ৩৫% পরিবহন শ্রমিক মাদকাসক্ত। আর এই মাদকাসক্ত পরিবহন শ্রমিকরাই প্রধানত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।’
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের দিয়ে যেকোন কাজ করানোই যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে তারা প্রতিদিন গাড়ি চালাচ্ছেন। কতটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা গণপরিবহর ব্যবহার করছি সেটা তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে রয়েছে যাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহারেরও অভিযোগ। যেকোন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিশেষ করে ঈদকে কেন্দ্র করে অধিক ভাড়া নেয়ার অভিযোগ তো আছেই। কিন্তু সেই অতিরিক্তি ভাড়াটা কয়েকগুণ হলেও জিম্মি হয়ে রয়েছে যাত্রীরা। যাত্রীদের অভিযোগও এই ঈদেও লোকাল পরিবহনগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে তিন/চারগুণ পরিমাণ বেশি ভাড়া আদায় করেছে। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করায় জোর করে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে অনেককে। পরিবহন স্বল্পতা আর ঘরে ফেরার টানে তাই বেশি ভাড়া দিয়েই যেতে হয়েছে ঈদ যাত্রায় ঘরমুখো মানুষকে। অথচ ঈদ যাত্রায় শুরুতেই বেশি ভাড়া আদায় বন্ধ করতে বলেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু বাস্তবে সেটি দেখা মেলেনি অধিকাংশ রুটেই।
এর বাইরে রয়েছে মহাসড়কে বেপরোয়া বাস চালানো। যার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইচ্ছামতো উল্টোপথে গাড়ি ঢুকিয়ে রাস্তা বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে অনেক রুটে।
এসব কিছুর মধ্যেই গতকাল সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০ ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিষদের ৪২তম এই বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো আগেও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে নৈরাজ্য ঠেকানো সম্ভব হয়নি, সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। যদিও ওই বৈঠকে পরিষদের সভাপতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘পরিবহন খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে, দিনেরাতে সবকিছু করা সম্ভব নয়।’
আমরাও জানি সড়কে শৃঙ্খলা একদিনে ফেরানো সম্ভব নয়। তবে নৈরাজ্যর নামে যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর হত্যা খেলায় মেতে উঠা মোটেই কাম্য নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে যাত্রীদের ওপর বাস-ট্রাক তুলে হত্যার দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হয়তো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব।