টানা এক বছর ধরে বাড়ির মালিকের ফ্ল্যাটের শুধু পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি ভাড়াটিয়া। বিদ্যুতের লাইনও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এক মাস যাবত। বাড়ির মালিকানা দাবি করে বাড়ি ছাড়াতে স্থানীয় মাস্তানদের মাধ্যমে বাড়িওয়ালাকে দেয়া হচ্ছে হুমকি। এমন ঘটনা রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের তাজমহল রোডের ২৬/১৭ নম্বর বাসাটিতে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের এই প্লটটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ১৯৬৮ সালে দীর্ঘমেয়াদী লীজ নেন আব্দুল কুদ্দুস। এরপর তিনি এখানে চার তলা বাড়ি করেন।
আব্দুল কুদ্দুসের কোন সন্তান ছিলো না। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তার এক পালিত মেয়ে ছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী ও পালিত মেয়েকে বাড়িটি দান করে যান।
সেই অনুযায়ী আব্দুল কুদ্দুসের পরিবর্তে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মাসুদা বেগম ও পালিত মেয়ে সুলতানা বিলকিসের মুন্নির নামে জাতীয় গৃহায়ণ কৃর্তপক্ষের অফিসে নামজারিও হয়।
এরপর ২০০৬ সালে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিক্রয় অনুমতি নিয়ে মা ও মেয়ে জনৈক মোশারফ হোসেন চৌধুরির কাছে সাফ কবলা হিসেবে বাড়িটি বিক্রি করে দেন।
মোশারফ হোসেনের নামেও বাড়িটি নামজারি হয়। মোশারফ হোসেন প্রবাসী। তিনি ২০১০ সালে হারুন অর রশিদ নামে একজনকে আমমোক্তার নামা দেন।
সেই আমমোক্তার নামার শর্ত অনুযায়ী সিটি কলেজের সাবেক অধ্যাপক গাজী জাহিদ হোসেন বাড়িটি হারুন অর রশীদের কাছ থেকে কেনেন।
এরপর জাহিদ হোসেন ও তার স্ত্রী মর্জিনা বেগমের নামে রেজিষ্ট্রিকৃত বায়না দলিল হয়। সেই বছরই তিনি বাড়িতে উঠে বসবাস শুরু করেন।
অধ্যাপক জাহিদ হোসেন যখন বাড়িটিতে ওঠেন তখন দ্বিতীয় তলায় মরিয়ম আক্তার ভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলেন। তিনি বাসা না ছেড়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে চান বলে জানান। দুই মাস ভাড়া দিলেও, পরে তিনি নানা ধরনের টালবাহানা করতে শুরু করেন।
এভাবে কয়েক বছর চলার পর হঠাৎ করেই তিনি বাড়ির চতুর্থ তলাটি দখল করে নেন এবং বাড়ির প্রথম মালিক আবদুল কুদ্দুসের প্রথম স্ত্রী ও ভাইসহ অন্যান্য ওয়ারিশদের মাধ্যমে তিনি এই বাড়ির আমমোক্তার নামা পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
বিষয়টি এরপর আদালতে গড়ায়। হাইকোর্টে এই বাড়ির বাটোয়ারা মামলা খারিজ হয়ে যাবার পরও মরিয়ম বাড়ির দখল ছাড়েননি।
উল্টো এলাকার কিছু মাস্তান ও রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় মরিয়ম গত এক বছর ধরে জোরপূর্বক গাজী জাহিদ হোসেনের বাসায় পানির লাইন কেটে দেন।
বাইরে থেকে বোতলের মাধ্যমে পানি এনে পরিবারটি জীবন ধারন করার সংগ্রাম এক বছর চালানোর পর গত এক মাসে আগে বাড়ির বিদ্যুৎ মিটারের সামনে এমন ভাবে বক্স করে তালা দেয়া হয়, যাতে করে কেউ তা খুলতে না পারে।
এতে করে প্রিপেইড মিটার আর রিচার্জ করতে পারছেন না অধ্যাপক জাহিদ। মিটারের সেই বক্স খুলতে গেলে জাহিদ হোসেন ও তার স্ত্রী-কন্যার ওপর চড়াও হয় মরিয়ম ও তার সাথে যোগ দেয় এলাকার মাস্তানরা।
গত ৯ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ অফিস থেকে লাইন ঠিক করতে গেলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারি মজিবর রহমানকে ডাকাত বলে বাড়িতে আটকে রাখে মরিয়ম।
এ সময় এলাকার চিহ্নিত মাস্তান হিসেবে পরিচত দোলোয়ার প্রায় ৫০ জনকে সাথে নিয়ে আসেন। পরে, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে লোকজন গিয়ে মজিবরকে ছাড়িয়ে আনেন।
ডিপিডিসির শ্যামলী জোনের উপ-সহকারি প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ জানান, ‘এমন পরিস্থিতি হবে তারা কল্পনাও করেনি। মরিয়মের কাছে গিয়ে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ করলে, তখন উল্টো ওই মহিলা বলেন, আমি আপনাদের বিরুদ্ধেও মামলা করবো’।
সরেজমিন ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জাহিদ হোসেনের দখলে থাকা নিচ তলা ও তৃতীয় তলা ঘুটঘুটে অন্ধকার। গরমে সেই বাসার মধ্যে ১০ মিনিটও থাকার উপায় নেই।
তারপরও ৭১ বছর বয়সি বৃদ্ধ জাহিদ হোসেন তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বিদ্যুৎ ও পানিবিহীন অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন।
মহল্লার অন্য বাড়িতে থেকে এই বয়োজেষ্ঠ্য শিক্ষক নিজে পানি বয়ে নিয়ে এসে বাথরুমে বোতলে রাখেন। আর খাবার পানি কিনে খাচ্ছেন।
জাহিদ হোসেনের স্ত্রী জানান, ভয়ে তিনি তৃতীয় তলা থেকে নিচে নামেন না। বিদ্যুৎ ও পানির অভাবে তারা বাড়ি থেকে বের হলেই পুরো বাড়ি দখল করে নেবে।
তিনি বলেন, সারাজীবনের কষ্টের টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন বাড়িটি। কিন্তু বাড়িটি কেনার পর তার বৃদ্ধ স্বামীর উপর চলছে নানাভাবে নির্যাতন।
বাড়িটির চতুর্থ তলায় ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে থাকেন মরিয়ম আক্তার। তার স্বামী থাকেন দক্ষিণ আফ্রিকাতে। মরিয়ম অকপটে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি স্বীকার করে নেন।
তিনি এটি পারেন কিনা জিজ্ঞেস করলে, মরিয়মের উত্তর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সলু ও সৌদি বাবুর সাপোর্টে তিনি এই কাজ করেছেন।
তার দাবি, তিনি বাড়ির প্রথম মালিক আব্দুল কুদ্দুসের ভাই-বোনদের কাছ থেকে আমমোক্তার নামা পেয়ে বাড়িটির মালিক হয়েছেন। তার দাবি মোশারফ হোসেন বাড়িটি কেনেন নাই। অথচ মরিয়মের কাছেই পাওয়া প্রিপেইড কার্ডে দেখা গেলো মোশারফ হোসেনের নাম।
এসব বিষয়ে প্রতিবেদক, মরিয়ম আক্তারের সাথে কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হন দেলোয়ার হোসেন।
তার পরিচয় জানতে চাইলে, মরিয়ম জানান দেলোয়ার হোসেন তার দাদা হন। স্বামী বিদেশে থাকায় দেশে বাড়ির কাজে সহায়তা থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকেন। আলাপচারিতায় দেলোয়ার নিজেকে ঠিকাদার পরিচয় দেন। পরে জানা যায়, দোলোয়ার মোহাম্মাদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিয়াচাঁনের ভাই।
এলাকাবাসী এবং আওয়ামী লীগের একাধিক ব্যাক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মরিয়ম আক্তার দেলোয়ারের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তারা জানেন। কারণ, তাদের ওঠা-বসা ও বাসায় সব সময় দেলোয়ারের অবস্থানের কারণে এলাকবাসীর কাছে সেটাই মনে হয়েছে।
এই দেলোয়ারই সব সময় কোনো ঘটনা ঘটলে মাস্তানদের নিয়ে বাড়ির সামনে মহড়া দেন। আর এই প্রতিবেদক থাকার সময়ে ওই বাড়িতে কয়েকজন যুবকদের সাথে উপস্থিত হন দেলোয়ার।
মরিয়মের সাথে পারিবারিক কিংবা বৈবাহিক সম্পর্ক আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম দেলোয়ারকে তার ভাই হিসেবে পরিচয় দেন। আর দেলোয়ার বলেন, এটি তাদের ব্যাক্তিগত বিষয়।
পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ হবার বিষয়টি মোহম্মদপুর থানায় একাধিক অভিযোগ জানানো হয়েছে। বেশ কয়েকবার পুলিশ আসলেও তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়নি তারা
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো: শহিদুল্যাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘সংবাদ প্রচার হলে বিষয়টি দেখা যাবে। এটা দেখভালের দায়িত্ব স্থানীয় কাউন্সিলের, তাকে বলেন’।
স্থানীয় কাউন্সিলর সলিম উল্লাহ সলু প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও পরে জানান, আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।
সূত্রঃ একাত্তর টেলিভিশন