Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

ফুটবল ইতিহাসের অমর উক্তি, ফুটবল জগত রক্তাক্ত এক নরক

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০২১, ০৯:২৩ AM আপডেট: ১২ আগস্ট ২০২১, ০৯:২৪ AM

bdmorning Image Preview


বার্সা সমর্থকদের মনের কোণের ছোট্ট আশাও শেষ করে দিলেন লাপোর্তা, ‘আরেকবার বলছি, কোনো মিথ্যে আশা তৈরি করতে চাই না। (মেসির সঙ্গে) চুক্তির আলোচনা শেষ হয়ে গেছে। এটা সত্যি ওর হাতে অন্য অনেক প্রস্তাব আছে, চুক্তির আলোচনার সময়ে সেসব আমরা শুনতে পেয়েছি। আমাদেরও চুক্তির আলোচনা শেষ করার জন্য একটা চূড়ান্ত দিনক্ষণ ছিল। লা লিগা শিগগিরই শুরু হচ্ছে। আর্থিক সঙ্গতির নীতিও (এফএফপি) একেবারে পরিষ্কার। একজন খেলোয়াড় এসবের মধ্যে ঝুলে থাকতে পারে না। ফুটবল সম্পর্কে টুকটাক খোঁজ খবর রাখলেই জেনে যাবেন ফুটবল জগত কখনো কখনো হয়ে ওঠে রক্তাক্ত এক নরক!

১৯৯৯ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ম্যাচটা প্রায় হেরেই যাচ্ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইনজুরি সময়ের গোলে অ্যালেক্স ফার্গুসনের দল ঠাঁই করে নেয় ইতিহাসে। প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে জেতে ট্রেবল।

ফার্গুসনের অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়েছিল এরপর। অনেক কথার ভিড়ে বলেছিলেন, 'ফুটবল, ব্লাডি হেল।' পরে সেটা ঢুকে গেছে ফুটবল ইতিহাসের অমর উক্তির উপরের সারিতে। মিশে গেছে খেলাটার সুখ, দুঃখ কিংবা বিস্মিত হওয়ার সঙ্গে।

কালো কোট আর টাই পরে আছেন, মুখে একই রঙের মাস্ক। ন্যু ক্যাম্পের প্রেস কনফারেন্স রুমে ঢুকলেন তিনি। ঢুকেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন, কাঁদতেই থাকলেন। যেন কোনো অবুঝ শিশুর প্রিয় খেলনাটা ভেঙে দিয়েছে কেউ। কান্নার তালেই চলতে থাকল হাত তালি। লোকটি কে আপনাকে কি আলাদা করে বলে দিতে হবে? -লিওনেল মেসি।

স্ত্রী আন্তেনেল্লো রোকুজ্জে বসে ছিলেন সামনেই। পরে ইন্সটাগ্রামে জানিয়েছেন, আবেগী হয়েছিলেন তিনিও। কিন্তু তখন স্বামীর কান্নাটাই মুখ্য তার কাছে। টিস্যু নিয়ে রোকুজ্জে এগিয়ে গেলেন। চোখ মুছতে মুছতে কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন লিওনেল মেসি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের একজন।

মেসি তখনো কাঁদছেন। ২১ বছরের আবেগ বলে কথা! চোখ মুছতে মুছতেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে গভীর বিষাদ। তার চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আবেগের ছাপ। তিনি বলতে শুরু করলেন, 'গত কয়েক দিনে অনেক ভেবেছি, কী বলব এখানে। সত্যিটা হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না....'

মেসির গলা ধরে আসে এরপর। কণ্ঠরোধ হয়ে আসে যেন। তিনি বলেন, 'এটা আমার ঘর, আমাদের ঘর। সন্তানদের কথা দিয়েছি, এখানে একদিন ফিরে আসবো।' এরপর তাকে হাসতে বলেন কোনো এক সংবাদকর্মী, শেষবার। মেসি হাসেন। নতুন খেলনা পাওয়ার পর বাচ্চারা যেমন হাসে, তেমন করে। বিচ্ছেদ হয় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে রোমান্টিক প্রেম কাহিনীর! বিখ্যাত সব উপন্যাসের প্রেমের মতোই!

ওই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টাও তখনো পার হয়নি ঠিকঠাক। ততক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেছে লিওনেল মেসির নতুন ঠিকানা হচ্ছে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই। আগে থেকেই তারা আলোচনায় ছিল। মাঝে বার্সেলোনার নতুন প্রস্তাবের খবর এসেছে, ম্যানচেস্টার সিটি নিয়ে আলোচনা অবশ্য থেমে গেছে আগেই। সব পেছনে ফেলে মেসি যাচ্ছেন প্যারিসে, নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ততক্ষণে উৎসব শুরু হয়েছে শহরটাতে। লে পার্ক দেস প্রিন্স স্টেডিয়ামের সামনে লাল গালিচা বসে গেছে। বিমানবন্দরের সামনে জড়ো হয়েছেন হাজারো সমর্থক। তাদের সবার একটাই চিৎকার, 'মেসি', 'মেসি'। তিনি তখনো বার্সেলোনায়। তার সতীর্থ ও বন্ধু পিকের মতে যে শহরটা তাকে ছাড়া আর কখনোই 'আগের মতো হবে না।' সে শহরটা ছেড়ে আসছেন তিনি। তার তিন 'কাতালান আর্জেন্টাইন' সন্তানকে নিয়ে।

দুই ঘণ্টা পর মেসি প্যারিসে পৌঁছান। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে পিএসজি একটি পোস্ট করে। তার আগে ইনস্টাগ্রামে স্টোরি দেন নেইমার, নিশ্চিত করেন মেসির বাবা জর্জে মেসিও। লিওনেলের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়।

কিছুক্ষণ পরই ছবি ছড়িয়ে পড়ে একের পর এক। 'দিস ইজ প্যারিস' টি শার্ট পরে নামেন মেসি। হাত নাড়ান চওড়া এক হাসিতে। হৃদয় এফোড় ওফোড় করা বিচ্ছেদ ছাপিয়ে প্যারিসে মেসি হাসেন আরও কয়েকবার। 

সুদূর বাংলাদেশে যখন রাতের গভীরতা বাড়ছে ধীরে ধীরে। তখন লিওনেল মেসি পোজ দেন পিএসজির জার্সিটা হাতে। ওহ, নম্বরটা কিন্তু ১০ না সেটার! রূপকথার গল্প লেখা হয়েছিল যে জার্সিটাতে। সেটা পেছনে ফেলে দেন। যতই বার্সার শুরুতে ৩০ নম্বর পরে খেলেন। আপনার চোখ নতুন করে ৩০-এ ধাদস্ত হতে নিশ্চয়ই সময় লাগে। আপনি বার্সেলোনা সমর্থক হলে, তার চেয়েও কি বেশি কষ্ট দেয় জার্সি হাতে মেসির ছবিটা?


দুইটা দৃশ্যেরই বর্ণনা শেষ। দুটিরই কেন্দ্রিয় চরিত্র লিওনেল মেসি। সম্ভবত একমাত্রও। তিনি কাঁদেন। সংবাদ মাধ্যমগুলো শিরোনাম হয়, 'মেসি কাঁদলেন, কাঁদালেন।' ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানেই মেসি হাসেন। নতুন অধ্যায় শুরুর আনন্দে। এত দ্রুত অঝোরে কান্না বদলে যায় হাসিতে। হয়তো মন খারাপ জমা থাকে তাতে। কিন্তু সেটাও হয়তো হাওয়া মিলিয়ে যাবে কদিন বাদে। দুইটা দৃশ্যই আরেকবার মনে করে আপনি চাইলে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসেনের অমর উক্তিটা আওড়াতে পারেন আরেকবার, 'ফুটবল, ব্লাডি হেল।'
ন্যাপকিনে শুরু, ন্যাপকিনে শেষ। গল্পটা এতদিনে জানা থাকার কথা। মেসির তখন হরমোনে সমস্যা। বাবা জর্জে কী করবেন ঠিকঠাক দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। সেই ২০০০ সালে কমলা দিয়ে ১১৩টি, টেনিস বলে ১৪০টি ও টেবিল টেনিস বলে ২৯টি ড্রিবলিংয়ের একটা ভিডিও বানানো হলো। আর্জেন্টাইন এক ব্যবসায়ীর হাত ধরে সেটা পৌঁছে গেল স্পেনে।

পেলেন বার্সেলোনার এক ক্লাব কর্তাও। মেসি ও তার বাবা আসলেন এখানে। বার্সার তখন সবমিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা। এই অবস্থায় ১৩ বছরের এক শিশুর জন্য ১৫০০শ ডলার খরচ করতে রাজি ছিলেন না ক্লাব কর্তারা। কিন্তু তাদের একজন মেসিকে হাত ছাড়া করতে চাইছিলেন না।

বাবা জর্জের তখন তাড়া। স্পেনে এসে কোনো চাকরি জুটেনি। তাকে দ্রুত ছুঁটে যেতে হবে রোজারিওতে। ওই ক্লাব কর্তা তাই চুক্তি সারলেন হাতের পাশে থাকা ন্যাপকিন পেপারে। পরে যেটা হয়ে পড়েছিল ইতিহাস। কী অদ্ভুত, মেসির শেষটাও হলো বার্সেলোনায় তার স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া টিস্যু পেপারে চোখ মুছতে মুছতে।

মাঝে লিওনেল মেসি কি করেছেন তা কি আলাদা করে বলার দরকার আছে? বার্সেলোনার হয়ে ৬৭২ গোল করেছেন, ক্লাবের সর্বোচ্চ অবশ্যই। জিতেছেন চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১০ টি লিগ আরও কত কী। সর্বকালের সেরা হয়ে উঠেছেন তো এখানেই।

কিন্তু বিচ্ছেদটা কেন হলো? দিনশেষে ফুটবলে বড় হয়ে ওঠা টাকার জন্য। মেসি অবশ্য নিজের বেতন অর্ধেক কমাতে তৈরি ছিলেন। বার্সেলোনাও প্রস্তুত ছিল নতুন চুক্তি করতে। তবে বাধা হয় দাঁড়ায় ওই 'অর্থই', বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে কেবল নিয়মনীতি। 

গত তিন বছরে শুধু ট্রান্সফার বাবদ বার্সা খরচ করেছিল ৯৬০ মিলিয়ন ইউরো। তাতে ঋণ করতে হয়েছে ৩২৩ মিলিয়ন। মোট ঋণের পরিমান দাঁড়ায় ১৩ বিলিয়ন ইউরো। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝার সঙ্গে যোগ হয় করোনা।

বার্সার মূল আয়ের উৎসের বেশির ভাগেই আঘাত হানে এই মহামারি। জাদুঘর, ক্লাবের অফিশিয়াল স্টোর বন্ধ। গত এক বছর ধরে করোনার কারণে ফাঁকা গ্যালারিতে ম্যাচ হওয়ায় বিক্রি হয়নি ম্যাচের টিকিটও। সঙ্গে শোনা যাচ্ছে জার্সিতে নাম লাগানো বাবদ স্পন্সর প্রতিষ্ঠান রাকুটুন যে অর্থ দিতো, সেটিও কমিয়ে আনা হয়েছে।

বার্সেলোনার আয়ের আরেকটি বড় উৎস চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। কিন্তু ২০১৫ সালের পর শেষ ষোলোর বেশি এই টুর্নামেন্টে যেতে পারেনি তারা। তাই আয়ও কমে গেছে এই খাত থেকে। 

আয় কমলেও বার্সেলোনার ফুটবলারদের বেতনের পেছনে ব্যয় কেবলই বেড়েছে। ২০১৯–২০ মৌসুমে বার্সেলোনা বেতনের জন্য খরচ করতে পারতো ৬৭ কোটি ১০ লাখ ইউরো, আয় কমে যাওয়া ও ঋণশোধের তাড়ায় সেটি ২০২০–২১ মৌসুমে হয়ে গেছে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ইউরো। অথচ ২০১৯ সালে তারা বেতনের পেছনে খরচ করে ৫০ কোটি ১০ লাখ ইউরো। যা ইউরোপের যেকোনো ক্লাবের চেয়ে অনেক বেশি।

এর মধ্যে উচ্চ মূল্যের বেতন পাওয়া ফুটবলারদের বিক্রিও করতে পারেনি বার্সা। কিছু ফুটবলার বেতন কমাতে রাজি হলেও বাকিদের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। মেসিকে দলে ভেড়ানোটা তাই এক পর্যায়ে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশ্যই সেটি আর্থিক কারণে। বার্সেলোনার নতুন করে কোনো খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে হলে আয় দেখাতে হবে ওই খেলোয়াড়ের বেতনের চার গুণ। যেটি মেসির ক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না বার্সার জন্য।

তাতে শেষ হয় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম রোমান্টিক প্রেম কাহিনীর। ন্যাপকিনে শুরু হওয়া গল্পটা শেষ হয় ন্যাপকিনেই। মেসি কাঁদেন, বুঝিয়ে যান নির্মম বাস্তবতা। প্রতিশ্রুতিও দেন আবার ফিরে আসার। কিন্তু কাতালান ক্লাবটির সমর্থকরা জেরার্ড পিকের 'কিছুই আবার আগের মত হবে না। না ক্যাম্প ন্যু, না বার্সেলোনা শহর, না আমরা।' কথাটার ভাবার্থ বুঝে আনমনে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সেই অমর উক্তিটিই হয়তো বলেন, 'ফুটবল, ব্লাডি হেল।'

Bootstrap Image Preview