Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

অলিম্পিকে বাংলাদেশের কেউ কথা রাখেনি

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ আগস্ট ২০২১, ০৮:৩৩ AM আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২১, ০৮:৩৩ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


আসলে প্রতিবার সেই একই ব্যর্থতার গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত সবাই। ‘হার-জিত বড় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’ এই আপ্তবাক্যই শেষ কথা হয়ে থাকছে। নিছক অংশগ্রহণই যেন বাংলাদেশের অলিম্পিক অর্জন। টোকিওতেও সেই পথেই হেঁটেছেন বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা।

বছরের পর বছর কেটে যায়, কেউ কথা রাখে না। ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখে যেতে হয় অন্যের উৎসব। এবারের অলিম্পিকেও সেই পুরনো আর চেনা দৃশ্য। আয়োজনজুড়ে চলছে পদকের লড়াই, আমাদের শুধু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখা, অনিমন্ত্রিত দর্শক! এ নিয়ে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তেমন সরব নয়। কেউ অন্তত আরিফুল-রোমান সানাদের শব্দের তীরে বিদ্ধ করছেন না।

টোকিও অলিম্পিক শেষ হতে আরও দিন কয়েক বাকি। তবে রোববারই বাংলােদেশের জন্য শেষ হয়ে হয়ে গেছে এই ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’।  অগ্রজ ক্রীড়াবিদদের মতোই ব্যর্থতার চোরাগলি ধরে হেঁটেছেন বাংলাদেশের ৬ প্রতিযোগী। এমনকি একটু আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা তীরন্দাজ রোমান সানা-দিয়া সিদ্দিকী, তারাও ব্যর্থ। প্রশ্ন উঠেছে- কতদিন আর অলিম্পিকের সেই শতবর্ষীয় পুরনো মন্ত্র ‘হার জিত বড় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’য় আটকে থাকবে বাংলাদেশ? অলিম্পিকে পদক প্রত্যাশাটা কি আসলেই মানায় না লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন একবার চোখ রাখি টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশি প্রতিযোগীদের নৈপুণ্যে

জুনাইনা আহমেদ (সাঁতার)

৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারের হিট থেকে বিদায় নিলেও তিনি ব্যক্তিগত রেকর্ড ভেঙেছেন। ২০১৯ সালে করা ৩০.৯৬ সেকেন্ড টাইমিংটি ছাড়িয়ে গেছেন এবারের অলিম্পিকে। টোকিও অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে ২৯.৭৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতার শেষ করেছেন তিনি। তবে প্রতিযোগিতার হিটে আট প্রতিযোগীর মধ্যে শেষ করেছেন পঞ্চম হয়ে। এতদিন তার সর্বোচ্চ টাইমিং ছিল ২৪.৯২ সেকেন্ড। ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়ানজুতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে এই টাইমিং করেছিলেন তিনি।

আরিফুল ইসলাম (সাঁতার)

টোকিওর অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে ৪ নম্বর হিটে ৩ নম্বর লেনে সাঁতরান আরিফুল। ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে ২৪.৮১ সময় নিয়ে তিনি তৃতীয় হয়েছেন নিজের হিটে। যা তার ক্যারিয়ার সেরা টাইমিং। সব মিলিয়ে ৭৩ সাঁতারুর মধ্যে ৫১তম হয়েছেন আরিফুল।

দিয়া সিদ্দিকী (আর্চার)
 
অলিম্পিকে নিজের অভিষেক রিকার্ভ একক ম্যাচে বেলারুশের জিওমিনস্কায়া কারিনার কাছে হেরেছেন টাইব্রেকারে। শুট অফ শেষে ৬-৫ গেমে হেরে এলিমিনেশন রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছেন তিনি।

রোমান সানা (আর্চার)
 
এলিমিনেশন রাউন্ড পেরিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটেনের টম হলের বিপক্ষে ৭-৫ গেমে জিতে। তাতে রেকর্ডও গড়া হয়ে গিয়েছিল সানার। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে অলিম্পিকে নকআউট ম্যাচেই জেতেননি আর কোনো প্রতিযোগী! এরপর শেষ ৩২-এর লড়াইয়ে অবশ্য ৬-৪ গেমে বিদায় নেন তিনি। এর আগে মিশ্র রিকার্ভ ম্যাচে রোমান আর দিয়া হেরেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। ৬-০ সেট পয়েন্টে হারা সেই ম্যাচে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি দুজনের জুটি।

আব্দুল্লাহ হেল বাকি (শুটার)

কমনওয়েলথ গেমসে দুটো রৌপ্য আছে তার দখলে। কিন্তু অলিম্পিক আরও একবার হতাশ করেছে আব্দুল্লাহ হেল বাকিকে। এবারও বাছাইপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশি এই শ্যুটার। টোকিও অলিম্পিকে আলাস্কা শ্যুটিং রেঞ্জে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের আবদুল্লাহ হেল বাকি।

জহির রায়হান (দৌড়)

ফিরেছেন হিট থেকে বাদ পড়েই। পুরুষ ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট তিনি শেষ করতে সময় নিয়েছেন ৪৮.২৯ সেকেন্ড। তাতে হিটের সব প্রতিযোগীর মধ্যে শেষতম হয়ে প্রতিযোগিতা শেষ করেন তিনি। সব মিলিয়ে হিটে ৪৭ প্রতিযোগীর মধ্যে ৪৪তম জহির।

সাঁতারু, স্প্রিন্টার, আর্চার- সবাই ফিরেছেন শূন্য হাতে। পদক জেতা তো দূরের কথা, আক্ষরিক অর্থে পদক জেতার লড়াইয়েই ঢুকতে পারেননি তারা। ১৮ কোটি মানুষের দেশটির প্রতিনিধিদের অলিম্পিক মিশন শেষ হলো ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জনেই!

১৯৮৪ থেকে ২০২১- দৃশ্যপট বদলায়নি এতটুুকু। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া আসরে প্রথম অংশগ্রহণ ১৯৮৪ সালে। সেই লস এঞ্জেলেসে বাংলাদেশের অলিম্পিক অভিষেক। তারপর লম্বা পথ পেরিয়ে এবার টোকিও, অভিজ্ঞতা সেই একই। অ্যাথলেটের নাম পাল্টেছে, কিন্তু পাল্টায়নি ব্যর্থতা। সাইদুর রহমান ডন থেকে বর্তমানের জহির রায়হান, সাফল্য সে তো সোনার হরিণ।

আধুনিক অলিম্পিকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিনের মূল মন্ত্র ‘জয়লাভ নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’- অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা। যেখানে মাত্র ৩৪ হাজার মানুষের দেশ সান মারিনো বিশ্বরেকর্ড গড়ে জেতে সোনার পদক, সেখানে আমরা শুধু বিশ্ব মঞ্চের অনাহুত অতিথি। 

শর্টকার্টেই সাফল্য পেতে চায় বাংলাদেশ। দিন শেষে সংগতভাবেই সাফল্য দূর আকাশের তারা হয়ে থাকে। এমন বড় আয়োজন মানেই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দয়ায় কর্মকর্তাদের ‘আনন্দ ভ্রমণে’র সুযোগ। প্রতিযোগীদের চেয়ে কর্মকর্তাদের বহর থাকে দ্বিগুণের বেশি।

কিন্তু কেন? এমনটা আর কতদিন চলবে? এই উত্তর খুঁজতে সাহায্য করলেন আসিফ হোসেন খান। নামটা চেনা লাগছে নিশ্চয়ই? ২০০২ সালে কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে স্বর্ণজয়ী শুটার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে। অবহেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই আসিফ জানাচ্ছিলেন, সংক্ষিপ্ত অনুশীলন দিয়ে পদক জেতা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, ‘এথেন্স অলিম্পিকের আগে আমি জার্মানিতে মাত্র দুই মাস অনুশীলন করেছি। আর সেখানে অভিনব বিন্দ্রা করেছে দীর্ঘদিন। বিন্দ্রা এথেন্সে সফল না হলেও সেই অনুশীলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কিন্তু ঠিকই ২০০৮ সালে সফল হয়েছে। আমি ২০০৮ সালে অংশই নিতে পারিনি।’

শর্টকার্টেই সাফল্য পেতে চায় বাংলাদেশ। দিন শেষে সংগতভাবেই সাফল্য দূর আকাশের তারা হয়ে থাকে। এমন বড় আয়োজন মানেই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দয়ায় কর্মকর্তাদের ‘আনন্দ ভ্রমণে’র সুযোগ। প্রতিযোগীদের চেয়ে কর্মকর্তাদের বহর থাকে দ্বিগুণের বেশি।

অলিম্পিকের মতো এমন বড় আসর শুরুর আগে হঠাৎ করেই ফেডারেশন কর্তাদের দৌড়-ঝাঁপ বেড়ে যায়। লবিং চলে কে দলের সঙ্গে ‘আনন্দ ভ্রমণে’ যেতে পারবেন। সরকারি টাকায় বিদেশ সফর। ফেরার পথে ফ্লাইটে লাগেজ ভর্তি গিফট তো আছেই। এখানে অ্যাথলেটদের নিয়ে ভাবার সময়টা কোথায়? আর এক মাসের চটজলদি ভাবনা দিয়েও কিছু হয় না! 

এটা দিনের আলোর মতো সত্য- আমরা আমাদের প্রতিযোগীদের ঠিকঠাক প্রস্তুত করতে পারি না। যে কোনো কিছুতেই সাফল্য পেতে চাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। দীর্ঘমেয়াদি ছকই সাফল্যের দরজা খুলে দেয়। বিশেষ করে অলিম্পিকের মতো আসরে রাতারাতি কিছু অর্জনের ফর্মুলা অবিষ্কার হয়নি। আর অবশ্যই চাই ক্রীড়াবিদদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির অনুশীলন সরঞ্জাম। এসব কি আছে আমাদের?

এ দেশের অ্যাথলেটরা অলিম্পিকে যাওয়ার ১৫ দিন আগেও জানতে পারেন না, তিনি যাচ্ছেন অলিম্পিকে। এবার টোকিও যাওয়ার এক মাস আগেও তাই জহির জানতেন না অলিম্পিকে যাবেন তিনি! দেশের দুই দ্রুততম মানব-মানবী মোহাম্মদ ইসমাইল ও শিরিন আক্তারকে উপেক্ষা করে পাঠানো হয় তাকে। অথচ উল্টো পিঠে একমাত্র কর্তারাই দুই বছর আগে থেকে জানেন, তাদের মধ্যে অলিম্পিক ভ্রমণে যাওয়া নিশ্চিত কার।

নিজেদের এই ভ্রমণ-চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে সবার আগে খেলোয়াড়দের ব্যাপারে সজাগ হওয়ার কথা ছিল ফেডারেশনের কর্তাদের। লম্বা সময়ের জন্য এই রোমানা সানা-আরিফুল ইসলামদের নিয়ে পরিকল্পনার ছক করার কথা ছিল তাদের। প্রয়োজন ছিল আধুনিক সরঞ্জামের। স্বজনপ্রীতি দূরে সরিয়ে সেরা প্রতিভাগুলো খুঁজে আনার কাজটাও তো হচ্ছে না যুগের পর যুগ ধরে। ক্রীড়াবিদদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাটা আশা করার সুযোগও তৈরি হয়নি।

 যদিও একটা ট্র্যাক আছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেটা যেন গোটা ক্রীড়াঙ্গনেরই চেহারা। জীর্ন-শীর্ন!  ট্র্যাকে গর্ত, কিছুদিন আগেই আস্ত ডাব আটকে থাকার একটা ছবিও ভাইরাল হয়েছিল। আর বৃষ্টিতে পানি জমার ঘটনাও তো নতুন নয়!

আসিফ হোসেন খান যেমনটা বলছিলেন, ‘আমি দেখেছি, আপনাদের ঢাকা পোস্টেই ২০০৮ বেইজিং গেমসে স্বর্ণজয়ী ভারতীয় শ্যুটার বিন্দ্রা বাংলাদেশের শ্যুটারদের প্রশংসা করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, উন্নত প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে বাংলাদেশের শ্যুটারদের অবশ্যই পদক পাওয়া সম্ভব।’

কিন্তু এই কথাগুলো আপাতত অরণ্যে রোদন। দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই নেই। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এখনো ঘাসের ট্র্যাকে হয় জাতীয় অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ। যদিও একটা ট্র্যাক আছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেটা যেন গোটা ক্রীড়াঙ্গনেরই চেহারা। জীর্ণ-শীর্ণ! ট্র্যাকের গায়ে হয়ে আছে বড় বড় গর্ত, কিছুদিন আগে আস্ত ডাব আটকে থাকার একটা ছবিও ভাইরাল হয়েছিল। আর বৃষ্টিতে পানি জমার ঘটনাও তো নতুন নয়!

এ কারণেই হয়তো ‘ঝড়ে বক না মরলে’ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ‘অভিজ্ঞতা’য় আরও বেশি সমৃদ্ধ হবেন আমাদের অ্যাথলেটরা। অলিম্পিকে এত প্রত্যাশা মানায় না এই দেশের! ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে তাঁরা শুধু অংশ নিতেই যাবেন অলিম্পিকে। আর আমরা প্রত্যাশায় লাগাম টেনে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার শরণার্থীদের গল্প শুনব কিংবা পাশের দেশের কাঠকুড়ানি মেয়ে মীরাবাই চানুর রুপা জয়ের খবরে বুঁদ হয়ে থাকব। অনেকটা সুনীলের সেই কবিতার লাইনের মতো- বছরের পর বছর কাটবে, কিন্তু কেউ কথা রাখবে না!

Bootstrap Image Preview