শিল্পের ক্ষুধা একজন শিল্পীকে পীড়া দেয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের কতজন শিল্পীর এই পিপাসা আছে? শিল্পপিপাসু হয়ে উঠতে নিজের ভেতরের শিল্পীসত্ত্বাকে জাগ্রত করা আবশ্যক। লাইট, ক্যামেরার ঝলকানিতে অনেক শিল্পীই সেটি ভুলে বসেন। তবে এই শিল্পসত্ত্বা থেকে নিজেকে আড়াল করতে চান না জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেতা অন্তু করিম। বর্তমান ব্যস্ততা ও অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে বিডিমর্নিং এর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাতে ছিলেন নিয়াজ শুভ-
ব্যস্ততা কেমন চলছে?
অন্তু করিমঃ মিউজিক ভিডিওটি করতে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। এটিকেই আমি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেই। আজকে আমি যতটুকু সম্মান অর্জন করেছি তার সিংহভাগ দিয়েছে মিউজিক ভিডিও। বিভিন্ন নাটক, বিজ্ঞাপনের কাজও করছি। কিন্তু মিউজিক ভিডিওর ব্যস্ততাটা বেশি।
নাটকে আপনার ধারাবাহিকতা...
অন্তু করিমঃ না, নাটকে নিয়মিত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সব ধরণের স্ক্রিপ্টে আমি কাজ করতে আগ্রহী না। মনের মতো স্ক্রিপ্ট পেলেই আমি কাজ করি। এছাড়া নাটকে নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছা নেই। যা করছি ভালোলাগা থেকে করছি।
অভিনয়ে নিয়মিত পাওয়া যাবে?
অন্তু করিমঃ মিডিয়াতে ১৮ বছর কেটে গেলো। দর্শক যতদিন আমার কাজ পছন্দ করবে ততোদিন কাজ করবো, দর্শক যখন চাইবে না আমি কাজ করা বন্ধ করে দিবো। কিন্তু আমি কাজের পরিমাণে বিশ্বাসী না। ২০১০ সালে যখন ‘এক জীবনে’ গানটি রিলিজ পায়, তখন যদি আমি পরিমাণে বিশ্বাস করতাম তাহলে আজকে কয়েকশো মিউজিক ভিডিও থাকতো। তা কিন্তু নেই। এই সাত-আট বছরে কিন্তু আমার ১৫-২০টা মিউজিক ভিডিও অতিক্রম করেনি। গান, দৃশ্যপট সবকিছুর যোগসূত্র হলে ভালোলাগার জায়গাটা থেকে কাজ করি। মাঝে দুই-একটা অনুরোধের ঢেঁকি গিলেছি। কিছু কিছু সময় কাছের অনেক লোকজন এমনভাবে অনুরোধ করেন যেটি না পাড়ি ফেলতে, না পারি সইতে। তবে এখন অনুরোধের জায়গাটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
বড় পর্দায় কাজের পরিকল্পনা...
অন্তু করিমঃ চলচ্চিত্রে কাজের অনেক সুযোগ এসেছে। আমি সবচেয়ে ছোট পর্দার মানুষ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিলো। সেই অনুযায়ী ২০০৮ সালে আমি একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলাম। সামনে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা আছে।
সিনেমার বর্তমান প্রেক্ষাপটে কি আপনি টাকা লগ্নি করতে চান?
অন্তু করিমঃ চলচ্চিত্র বানাবো আমার ভালোবাসার জায়গা থেকে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এ আমার বাবা অভিনয় করেছিলেন। সেই টান থেকেই আমি চলচ্চিত্র বানিয়েছি। আমার চলচ্চিত্র দেশ-বিদেশে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী যে সিনেমাটা বানাবো সেটি ব্যবসায়িক চিন্তা করে বানাবো না। বিকল্প ধারার ছবির প্রতি আমার আগ্রহ আছে। সব কাজই কিন্তু লাভবান হয় না। তারপরও কিন্তু সবাই কাজ করে যাচ্ছে। ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই কিন্তু আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমি একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই। সফল হতে পারবো কিনা জানিনা। তবে সেটি আমি লাভ-ক্ষতির চিন্তা করে বানাবো না। শিল্পটাকে প্রাধান্য দিবো।
টাকা লগ্নির সাথে অবশ্যই স্বার্থ জড়িত। সেই জায়গায় নিশ্চই...
অন্তু করিমঃ অবশ্যই স্বার্থ আছে। ভালো স্ক্রিপ্টের অপেক্ষায় রয়েছি। আমি শিল্পী। ছোটবেলা থেকেই থিয়েটার করতাম। আমার ক্ষুধাটা শুধুই শিল্প। আমি সবসময় শিল্পটাকে প্রাধান্য দেই। আমি এর মাঝেই থাকতে চাই। ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র বানাবো। কিন্তু চলচ্চিত্র থেকে টাকা কামানোর ইচ্ছা আমার নেই। শিল্পপিপাসু মনকে তৃপ্ত করার মাঝেই সুখ খুঁজে পাই।
আপনার দৃষ্টিকোণে মিডিয়ার বর্তমান অবস্থা কেমন?
অন্তু করিমঃ যখন মানুষ ভেবেছিলো বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি শেষ, তখন আমরা মিউজিক ভিডিও নিয়ে হাজির হওয়ার পর পুরো ইন্ডাস্ট্রির চেহারা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। মিউজিক ভিডিও সেক্টর থেকে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। এটি এখন একটি শিল্প হয়ে গেছে। যেখানে মানুষ এক টাকা লগ্নি করতে চাইতো না, সেখানে আজ অনেক মিউজিক ভিডিওতে একটি নাটকের চেয়ে বেশি খরচ করছে। ব্যবসা না থাকলে তো মানুষ এখানে ইনভেস্ট করতো না। বলা চলে, একটি নতুন সেক্টরের জন্ম হয়েছে। চলচ্চিত্র একটি সেক্টর, নাটক একটি সেক্টর তেমনি এখন মিউজিক ভিডিও একটি সেক্টর হয়ে উঠেছে।
বাস্তবিক অর্থে অনেকেই ভিডিও দেখার জন্যই গান শুনছেন...
অন্তু করিমঃ না, এরকম আপনি, আমি ভাবা শুরু করলেই হতে থাকবে। কিন্তু এটা কেন হতে দিবো আমরা? আমি অভিনয়শিল্পী, আমি বলতেই পারি আমি ভিডিও করি বলে গানটি চলে। কিন্তু না, গানটা ভালো বিধায় আমার ভিডিও চলে। আমি গানটাকে প্রাধান্য দেই।
স্রোতের সাথে থাকতে হয়। স্রোতের বিপরীতে বেশিক্ষণ চলা যায় না। মিউজিক ভিডিও ছাড়াও কিন্তু অনেক লিরিক্যাল ভিডিও আছে। সেগুলোও অনেক ভিউ হয়। গান ভালো হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আসলে কাজ করছি গানের জন্য। ভিডিওর জন্য গান না, গানের জন্য ভিডিও। আমরা গানের একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করছি।
নতুনদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
অন্তু করিমঃ সেন্ডেল ক্ষয় করা শিল্পী আমি। একেবারে রুট লেভেল থেকে আজকের অবস্থানে এসেছি। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে গিয়ে ফ্রি শুটিং করে আসছি। এখন আমার বাসার নিচে গাড়ি অপেক্ষা করতে দেখি। দুটো পাঠই আমি দেখেছি। আমি বুঝি কখন কোনটাকে কিভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি কখনো এক মিনিট লেট করে সেটে আসিনি। কিন্তু নতুনদের ক্ষেত্রে যেটা দেখেছি (আমার ভুল ধারণা হতে পারে) তাদের মধ্যে ডেডিকেশন অনেক কম। যখন আমি কোন কাজ করি, আমার জন্য পুরো ইউনিট বসে থাকে। প্রতিটা মিনিট প্রোডিউসারের খরচ হচ্ছে। আমি তাদেরকে কিভাবে বসিয়ে রাখবো? সবাইকে সেটা বুঝতে হবে। নতুনদের মধ্যে শেখার আগ্রহ খুব কম। তাদের চিন্তাধারায় শুধু ফেইম। তারা মনে করেন, আমি ফেইমে থাকবো মানুষ আমাকে চিনবে। কিন্তু তাদের মধ্যে ভালো কিছু করার আগ্রহ খুবই কম। কলিজার ভেতরে লাগার মতো কাজের যে ক্ষুধা, সেটি তাদের মধ্যে নেই।
মিডিয়ার বাইরে কি করছেন?
অন্তু করিমঃ মিডিয়ার বাইরে আমি একজন নিয়মিত ব্যবসায়ী। সেটিই আমার মূল পেশা। বেবি কেয়ার প্রোডাক্টের আমদানি ও সারাদেশে বাজারজাত করি।
ব্যবসা, অভিনয় একসাথে সামলাচ্ছেন কিভাবে?
অন্তু করিমঃ যেহেতু এটি আমার নিজস্ব ব্যবসা, তাই আমি আমার সময় বের করে নিতে পারি। আমার যখন শুটিং থাকে তার তিন-চারদিন আগে থেকেই আমি আমার কাজ গুছিয়ে রাখি। কারণ আমি জানি কোন তারিখে আমি থাকবো না। সেই দিনের কাজগুলো আমি আগেই গুছিয়ে রাখি।
ব্যবসায়ী নাকি শিল্পী, নিজেকে কোন পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
অন্তু করিমঃ আমাকে মানুষ যেভাবে চিনে, সেভাবেই থাকতে চাই। পেশাগত শিল্পী বা সৌখিন শিল্পী যা ভাবুক সেই পরিচয়েই থাকতে চাই। যেহেতু এই ক্ষেত্রটাকে ভালোবাসি, সেহেতু প্রযোজনা করবো।
পরিবার থেকে কিভাবে সাপোর্ট পাচ্ছেন?
অন্তু করিমঃ আমার পরিবার আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছে। তা না হলে এত লম্বা সময় পার করতে পারতাম না।
ভক্তদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন...
অন্তু করিমঃ ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তারা আছে বলেই আমি আছি। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন আমি যেন ভালো কাজ করতে পারি। বাংলাদেশের কাজের সাথে যেন থাকতে পারি। বিশ্বের অনেক কাজের মাঝে যেন বাংলার কাজটা তুলে ধরতে পারি।
এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অন্তু করিমঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।