আট বছরের অনীক খেতে বসে প্রায়ই বেঁকে বসে—পাতে মাছ চাই। রিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেকে বোঝান। বেশি ঘ্যান ঘ্যান করলে কষে চড়। সন্তানদের জন্য ঘরে শেষ কবে মাছ-মাংস রান্না হয়েছে, মনে পড়ে না রিনা নায়েকের।
শেষে ভরসা দেন, মাছ রান্না হবে শিগগিরই। অথচ নিজেই জানেন এ আশা দূরাশা মাত্র।
এই একটুখানি চিত্রে বোঝা যায় চা শ্রমিক রিনার (৪৫) সংসারের হাল। কেমন যাচ্ছে তাঁর দিনকাল। সিলেটের আলী বাহার চা বাগানের শ্রমিক তিনি। স্বামী চা শ্রমিক অলিন নায়েক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। এখন তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর একলা আয়ের সংসার। কিন্তু স্বল্প টাকার দিনমজুরিতে কি আর সংসার চলে?
রিনা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও বড় মেয়ে অষ্টমীর (১৯) পড়াশোনা হয়নি। পরীক্ষার ফি না দিতে পারায় ছোট মেয়ে নমমীর (১৬) স্কুলে যাওয়া আটকে গেছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ছেলেটি অবশ্য স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।সারা দিন চা-বাগানে কাজ করতে হয় রিনাকে। মজুরি মাত্র ১১৮ টাকা। এ থেকে সমিতি ও পূজার চাঁদা দিতে হয়। নিরুপায় রিনা বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম তো বাড়তেই আছে। আমাদের মজুরি তো বাড়ে না। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কেমনে চলব?’
তিনি বলেন, ‘বাগান থেকে রেশন বলতে সপ্তাহে আমি সাড়ে তিন কেজি চাল পাই। ছোট দুই ছেলেমেয়ে পায় তিন কেজি করে। মোটে এই সাড়ে ছয় কেজি চালই। ’গতকাল বৃহস্পতিবার পাওয়া রেশনের চালে চলে রবিবার পর্যন্ত। এরপর কিনে খাও। টান পড়লে দোকান থেকে বাকিতে সদাই কিনতে হয়। বেশি টাকা জমলে দোকানি বাকি দেন না। তখন এনজিও থেকে সুদে ঋণ তুলে দোকানের টাকা শোধ করতে হয় চা শ্রমিকদের।রিনা বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের বলি, তোমরা কম করে রান্নাবান্না করে খাও। যাতে সপ্তাহটা কোনো মতে পার হয়। শেষ হয়ে গেলে আমি পাব কোথায়?’
তিনি বলেন, ‘সকালে এটা-সেটা কিছু একটা দিয়ে চালিয়ে দিই। দুপুরে মাড়-ভাত লবণ ছিটিয়ে বা ভাত-আলুভর্তা দিয়ে খায়। কিন্তু রাতে তো আমাদের খাওয়াই লাগবে। ’ছোট ছেলের আবদারের কথা তুলে রিনা বলেন, ‘ছেলে বলে, মাছ খাব, মাংস খাব। এগুলো খাব না, ভালো লাগে না। ছেলেকে থাপ্পড় দিয়ে, বুঝিয়ে শান্ত করি। বলে ডিম খাব। ডিমের দাম তো এখন ১৫ টাকা। এত টাকা দিয়ে ছেলেকে ডিম খাওয়াব কেমনে?’মেয়েদের পড়াতে চেয়েছিলেন জানিয়ে রিনা বলেন, ‘বড় মেয়ের পড়া বন্ধ। দ্বিতীয় মেয়ে নমমীকে স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। বেতন দিতে পারি না। শিক্ষকদের বলেছি, একটু সাহায্য করেন। বাড়তি টাকা হাতে এলে মাসের বেতন সব দিয়ে দেব। তাঁরা সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার ফি দিতে পারিনি। তাই মেয়ের পড়া বন্ধ। ’
বাগানের শ্রমিকদের জন্য অসুখ বড় আতঙ্কের নাম জানিয়ে রিনা বলেন, ‘বাগানে একজন চিকিৎসক থাকার নিয়ম থাকলেও আমাদের বাগানে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না দীর্ঘদিন। অনেক চাপাচাপির পর একজন কম্পাউন্ডারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার কাছে গেলেই নাপা না হয় হিস্টাসিন দেয়। সে পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা আর পেটের অসুখ হোক। ’বড় ধরনের অসুখ হলে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘সেখানে চিকিৎসা করালে মালিকপক্ষ কিছু সহযোগিতা করে। পাঁচ-ছয় হাজার খরচ হলে দুই হাজার দেয়। ’ তিনি বলেন, ‘জটিল অসুখ হলে বা অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তারা সহযোগিতা করে না। শুধু ওসমানীতে হলে কিছু সহায়তা করে। ’
আলী বাহার চা-বাগানের ব্যবস্থাপক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আমাদের বাগানে এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। ছোট বাগান, সি গ্রেডের। এখানে এ গ্রেডের বাগানের মতো সুবিধা দেওয়া কঠিন। তবে বাগানের?কেউ অসুস্থ হলে আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। আর চিকিৎসক না থাকলেও বাগানের পাশেই তো রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালও খুব দূরে নয়। ’চিকিৎসায় সহযোগিতা না করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তো সাধ্যমতো চেষ্টা করি। তারা তো আমাদেরই মানুষ। হয়?তো পুরোপুরি চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না। ’