গায়ে আগুন দিয়ে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ গাজী আনিসুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় শোকে ভাসছেন কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ৫০ বছর বয়সী গাজী আনিসুরকে কুষ্টিয়ার মানুষ চেনে গাজী আনিস নামে। এক সময় কুষ্টিয়ার রাজপথ কাঁপানো এই নেতা ছিলেন অনেকের রাজনৈতিক গুরু। তার করুণ মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চোখে দেখা গেছে শোকের অশ্রু। ঘটনার পেছনের কারণ উদঘাটন করে দোষীদের শাস্তির দাবি তাদের।
গাজী আনিসের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ৯০ পরবর্তী সময়ে। তখন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৯৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্ব পান তিনি। সে সময় বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছেন আনিস। প্রচণ্ড সাহসী আনিস থাকতেন অগ্রভাগে। নানা অত্যাচার-নির্যাতন ও পুলিশি হয়রানির মুখেও মাঠ ছাড়েননি। তার এমন আত্মহন মেনে নিতে পারছেন না তার রাজতৈনিক সহকর্মীরা।
তাকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ করে জেলা ছাত্রলীগের গাজী আনিস-লালন কমিটির তৎকালীন সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক রাশিদুজ্জামান খান টুটুল বলেন, গাজী আনিস যখন জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন তখন আমরা তার কর্মী ছিলাম। তিনি প্রচণ্ড সাহসী নেতা ছিলেন। ১৫-২০ জন কর্মী নিয়ে মিছিলে তিনি মাঠ কাঁপিয়ে দিতেন। পুলিশসহ প্রতিপক্ষরাও তাকে ভয় পেত।
তিনি বলেন, সে সময় বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিতে কেউ আসতে চাইত না। মাঠের পরিবেশ ছিল বিরূপ। সেই কঠিন সময়ে গাজী আনিস ছাত্রলীগের হাল ধরেন। তাকে হারিয়ে আমরা ব্যথিত। তার মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা।
গাজী আনিসের সময়ে রাজনীতি করা আনিসুজ্জামান ডাবলু বলেন, আমার পরে কমিটির নেতা ছিলেন গাজী আনিস। তার আগের কমিটিতে আমি প্রচার সম্পাদক ছিলাম। তৃণমূল থেকে রাজনীতিতে উঠে আসনে আনিস। প্রতিভাবান একজন নেতা ছিলেন। তবে নানা কারণে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। মাঝেমধ্যে তার সাথে কথা হতো। এমন মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়।
জানা গেছে, সাবেক এই ছাত্র নেতা ব্যবসায় জড়িয়ে দীর্ঘ সময় রাজনীতি থেকে দূরে সরে ছিলেন। পরে তাকে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্য পদ দেওয়া হয়। বিগত জেলা কমিটির সদস্য করা হয় গাজী আনিসকে। এরপর মাঝে ফের সক্রিয় হন তিনি। ব্যবসায় পুঁজি হারানোর পর নানা কারণে হতাশায় ভুগছিলেন তিনি।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি খন্দকার ইকবাল মাহমুদ বলেন, গাজী আনিস রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করতেন। তিনি কবিতা ও গল্প লিখতেন। নানা প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর খবর নেতা-কর্মীদের ব্যথিত করেছে। একজন প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হারাল দল।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, গাজী আনিস দীর্ঘ সময় রাজনীতির বাইরে ছিলেন। আমিই তাকে ডেকে এনে বিগত কমিটিতে সদস্য পদ দিয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিই। তবে তিনি নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। অনেক বিষয় আছে যা আসলে বলা যায় না। তারপরও গাজী আনিসের মতো কর্মীকে দলের প্রয়োজন ছিল। তাকে হারানোর ফলে আমরা ব্যথিত। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই আমরা।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি জাহিদ হোসেন জাফর বলেন, গাজী আনিস ও আমার গ্রাম কুমারখালীর পান্টিতে। তার মৃত্যুতে গ্রামের মানুষ শোকাহত।
গাজী আনিস গতকাল সোমবার বিকেল ৫টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ফটকের ভেতরে খোলা স্থানে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। তার শরীরে আগুন দেখে আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে গিয়ে আগুন নেভান। কিন্তু তার আগে আনিসের পোশাক সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া আনিসকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের ভর্তি করানো হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
গায়ে আগুন দেওয়ার আগে এক ফেসবুক পোস্টে গাজী আনিস জানিয়েছিলেন, হেনোলাক্স গ্রুপের কাছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা পান তিনি। বর্তমানে লভ্যাংশসহ নুরুল আমিনের কাছে তার ন্যায্য পাওনা তিন কোটি টাকার বেশি। এই টাকা না পাওয়ায় গাজী আনিস নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এই মৃত্যুর ঘটনায় হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে আজ দুপুরে শাহবাগ থানায় মামলা করেন গাজী আনিসের ভাই নজরুল ইসলাম। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে আজ সন্ধ্যার পর রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব।